নৌকা ডুবি

ক্রমে আপিস-ঘরের আলো নিবিয়া গেল। কেরানি ঘরে তালা বন্ধ করিয়া হিমের ভয়ে মাথায় র৻াপার মুড়ি দিয়া নির্জন শস্যক্ষেত্রের মাঝখান দিয়া ধীরে ধীরে কোন্‌ দিকে চলিয়া গেল, আর দেখা গেল না।

কমলা যে অনেকক্ষণ ধরিয়া চুপ করিয়া জাহাজের রেল ধরিয়া পশ্চাতে দাঁড়াইয়া ছিল, রমেশ তাহা জানিতে পারে নাই। কমলা মনে করিয়াছিল, সন্ধ্যাবেলায় রমেশ তাহাকে ডাকিয়া লইবে। এইজন্য কাজকর্ম সারিয়া যখন দেখিল রমেশ তাহার খোঁজ লইতে আসিল না, তখন সে আপনি ধীরপদে জাহাজের ছাদে আসিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু তাহাকে হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইতে হইল, সে রমেশের কাছে যাইতে পারিল না। চাঁদের আলো রমেশের মুখের উপরে পড়িয়াছিল– সে মুখ যেন দূরে, বহুদূরে; কমলার সহিত তাহার সংস্রব নাই। ধ্যানমগ্ন রমেশ এবং এই সঙ্গিবিহীনা বালিকার মাঝখানে যেন জ্যোৎস্না-উত্তরীয়ের দ্বারা আপাদমস্তক আচ্ছন্ন একটি বিরাট রাত্রি ওষ্ঠাধরের উপর তর্জনী রাখিয়া নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া পাহারা দিতেছে।

রমেশ যখন দুই হাতের মধ্যে মুখ ঢাকিয়া টেবিলের উপরে মুখ রাখিল তখন কমলা ধীরে ধীরে তাহার কামরার দিকে গেল। পায়ের শব্দ করিল না, পাছে রমেশ টের পায় যে কমলা তাহার সন্ধান লইতে আসিয়াছিল।

কিন্তু তাহার শুইবার কামরা নির্জন, অন্ধকার– প্রবেশ করিয়া তাহার বুকের ভিতর কাঁপিয়া উঠিল, নিজেকে একান্তই পরিত্যক্ত এবং একাকিনী বলিয়া মনে হইল; সেই ক্ষুদ্র কাঠের ঘরটা একটা কোনো নিষ্ঠুর অপরিচিত জন্তুর হাঁ-করা মুখের মতো তাহার কাছে আপনার অন্ধকার মেলিয়া দিল। কোথায় সে যাইবে? কোন্‌খানে আপনার ক্ষুদ্র শরীরটি পাতিয়া দিয়া সে চোখ বুজিয়া বলিতে পারিবে “এই আমার আপনার স্থান?’

ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়াই কমলা আবার বাহিরে আসিল। বাহিরে আসিবার সময় রমেশের ছাতাটা টিনের তোরঙ্গের উপর পড়িয়া গিয়া একটা শব্দ হইল। সেই শব্দে চকিত হইয়া রমেশ মুখ তুলিল এবং চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দেখিল, কমলা তাহার শুইবার কামরার সামনে দাঁড়াইয়া আছে। কহিল, “একি কমলা! আমি মনে করিয়াছিলাম, তুমি এতক্ষণে শুইয়াছ। তোমার কি ভয় করিতেছে নাকি? আচ্ছা, আমি আর বাহিরে বসিব না– আমি এই পাশের ঘরেই শুইতে গেলাম, মাঝের দরজাটি বরঞ্চ খুলিয়া রাখিতেছি।”

কমলা উদ্ধতস্বরে কহিল, “ভয় আমি করি না।” বলিয়া সবেগে অন্ধকার ঘরের মধ্যে ঢুকিল এবং যে দরজা রমেশ খোলা রাখিয়াছিল তাহা সে বন্ধ করিয়া দিল। বিছানার উপরে আপনাকে নিক্ষেপ করিয়া মুখের উপরে একটা চাদর ঢাকিল; সে যেন জগতে আর-কাহাকেও না পাইয়া কেবল আপনাকে দিয়া আপনাকে নিবিড়ভাবে বেষ্টন করিল। তাহার সমস্ত হৃদয় বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। যেখানে নির্ভরতাও নাই, স্বাধীনতাও নাই, সেখানে প্রাণ বাঁচে কী করিয়া?

রাত্রি আর কাটে না। পাশের ঘরে রমেশ এতক্ষণে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। বিছানার মধ্যে কমলা আর থাকিতে পারিল না। আস্তে আস্তে বাহিরে চলিয়া আসিল। জাহাজের রেলিং ধরিয়া তীরের দিকে চাহিয়া রহিল। কোথাও জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নাই– চাঁদ পশ্চিমের দিকে নামিয়া পড়িতেছে। দুই ধারের শস্যক্ষেত্রের মাঝখান দিয়া যে সংকীর্ণ পথ অদৃশ্য হইয়া গেছে, সেই দিকে চাহিয়া কমলা ভাবিতে লাগিল– এই পথ দিয়া কত মেয়ে জল লইয়া প্রত্যহ আপন ঘরে যায়। ঘর! ঘর বলিতেই তাহার প্রাণ যেন বুকের বাহিরে ছুটিয়া আসিতে চাহিল। একটুখানি মাত্র ঘর– কিন্তু সে ঘর কোথায়! শূন্য তীর ধুধু করিতেছে, প্রকাণ্ড আকাশ দিগন্ত হইতে দিগন্ত পর্যন্ত স্তব্ধ। অনাবশ্যক আকাশ, অনাবশ্যক পৃথিবী– ক্ষুদ্র বালিকার পক্ষে এই অন্তহীন বিশালতা অপরিসীম অনাবশ্যক– কেবল তাহার একটিমাত্র ঘরের প্রয়োজন ছিল।

এমন সময় হঠাৎ কমলা চমকিয়া উঠিল– কে একজন তাহার অনতিদূরে দাঁড়াইয়া আছে।

“ভয় নাই মা, আমি উমেশ। রাত যে অনেক হইয়াছে, ঘুম নাই কেন?”

এতক্ষণ যে অশ্রু পড়ে নাই, দেখিতে দেখিতে দুই চক্ষু দিয়া সেই অশ্রু উছলিয়া পড়িল। বড়ো বড়ো ফোঁটা কিছুতে বাধা মানিল না, কেবলই ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। ঘাড় বাঁকাইয়া কমলা উমেশের দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া লইল। জলভার বহিয়া মেঘ ভাসিয়া যাইতেছে– যেমনি তাহারই মতো আর-একটা গৃহহারা হাওয়ার স্পর্শ লাগে অমনি সমস্ত জলের বোঝা ঝরিয়া পড়ে; এই গৃহহীন দরিদ্র বালকটার কাছ হইতে একটা যত্নের কথা শুনিবামাত্র কমলা আপনার বুক-ভরা অশ্রুর ভার আর রাখিতে পারিল না। একটা-কোনো কথা বলিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু রুদ্ধ কণ্ঠ দিয়া কথা বাহির হইল না।

পীড়িতচিত্ত উমেশ কেমন করিয়া সান্ত্বনা দিতে হয় ভাবিয়া পাইল না। অবশেষে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ এক সময়ে বলিয়া উঠিল, “মা, তুমি যে সেই টাকাটা দিয়াছিলে, তার থেকে সাত আনা বাঁচিয়াছে।”

তখন কমলার অশ্রুর ভার লঘু হইয়াছে। উমেশের এই খাপছাড়া সংবাদে সে একটুখানি স্নেহমিশ্রিত হাসি হাসিয়া কহিল, “আচ্ছা, বেশ, সে তোর কাছে রাখিয়া দে। যা, এখন শুতে যা।”

চাঁদ গাছের আড়ালে নামিয়া পড়িল। এবার কমলা বিছানায় আসিয়া যেমন শুইল অমনি তাহার দুই শ্রান্ত চক্ষু ঘুমে বুজিয়া আসিল। প্রভাতের রৌদ্র যখন তাহার ঘরের দ্বারে করাঘাত করিল তখনো সে নিদ্রায় মগ্ন।

২৮

শ্রান্তির মধ্যে পরের দিন কমলার দিবসারম্ভ হইল। সেদিন তাহার চক্ষে সূর্যের আলোক ক্লান্ত, নদীর ধারা ক্লান্ত, তীরের তরুগুলি বহুদূরপথের পথিকের মতো ক্লান্ত।

0 Shares