নৌকা ডুবি

শৈলজার স্বামী বিপিন গাজিপুরে অহিফেন-বিভাগে কাজ করে। চক্রবর্তীর দুটিমাত্র মেয়ে। বড়ো মেয়ে তো শ্বশুরবাড়ি গেছে। ছোটোটিকে প্রাণ ধরিয়া বিদায় দিতে না পারিয়া চক্রবর্তী একটি নিঃস্ব জামাই বাছিয়া আনিলেন এবং সাহেব-সুবাকে ধরিয়া এইখানেই তাহার একটা কাজ জুটাইয়া দিলেন। বিপিন ইঁহাদের বাড়িতেই থাকে।

কথা কহিতে কহিতে হঠাৎ এক সময় শৈল বলিল, “তুমি একটু বোসো ভাই, আমি এখনি আসিতেছি।” পরক্ষণেই একটু হাসিয়া কারণ দর্শাইয়া কহিল, “উনি স্নান করিয়া ভিতরে আসিয়াছেন, খাইয়া আপিসে যাইবেন।”

কমলা সরল বিস্ময়ের সহিত প্রশ্ন করিল, “তিনি আসিয়াছেন তুমি কেমন করিয়া জানিতে পারিলে?”

শৈলজা। আর ঠাট্টা করিতে হইবে না। সকলেই যেমন করিয়া জানিতে পারে আমিও তেমনি করিয়া জানি। তুমি নাকি তোমার কর্তাটির পায়ের শব্দ চেন না?

এই বলিয়া হাসিয়া কমলার চিবুক ধরিয়া একটু নাড়া দিয়া আঁচলে-বদ্ধ চাবির গোছা ঝনাৎ করিয়া পিঠের উপর ফেলিয়া মেয়ে কোলে লইয়া শৈলজা চলিয়া গেল। পদশব্দের ভাষা যে এতই সহজ তাহা কমলা আজও জানিতে পারে নাই। সে চুপ করিয়া বসিয়া জানলার বাহিরে চোখ রাখিয়া তাই ভাবিতে লাগিল। জানলার বাহিরে একটা পেয়ারা-গাছে ডাল ছাইয়া পেয়ারার ফুল ধরিয়াছে, সেই-সমস্ত ফুলের কেশরের মধ্যে মৌমাছির দল তখন লুটোপুটি করিতেছিল।

৩২

একটু ফাঁকা জায়গায় গঙ্গার ধারে একটা আলাদা বাড়ি লইবার চেষ্টা হইতেছে। রমেশ, গাজিপুর-আদালতের বিধি-অনুসারে প্রবেশ লাভ করিবার জন্য ও জিনিসপত্র আনিতে এক বার কলিকাতায় যাইতে হইবে স্থির করিয়াছে, কিন্তু কলিকাতায় যাইতে তাহার সাহস হইতেছে না। কলিকাতার একটা বিশেষ গলির চিত্র মনে উঠিলেই রমেশের বুকের ভিতরটা এখনো যেন কিসে চাপিয়া ধরে। এখনো জাল ছেঁড়ে নাই, অথচ কমলার সহিত স্বামিস্ত্রীর সম্বন্ধ সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করিয়া লইতে বিলম্ব করিলে আর চলে না। এই-সমস্ত দ্বিধায় কলিকাতায় যাত্রার দিন পিছাইয়া যাইতে লাগিল।

কমলা চক্রবর্তীর অন্তঃপুরেই থাকে। এ বাংলায় ঘর নিতান্ত কম বলিয়া রমেশকে বাহিরের ঘরেই থাকিতে হয়; কমলার সহিত তাহার সাক্ষাতের সুযোগ হয় না।

এই অনিবার্য বিচ্ছেদব্যাপার লইয়া শৈলজা কেবলই কমলার কাছে দুঃখপ্রকাশ করিতে লাগিল। কমলা কহিল, “কেন ভাই, তুমি এত হাহুতাশ করিতেছ? এমনি কী ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে!”

শৈলজা হাসিয়া কহিল, “ইস, তাই তো! একেবারে যে পাষাণের মতো কঠিন মন! ও-সব ছলনায় আমাকে ভুলাইতে পারিবে না। তোমার মনের মধ্যে যে কী হইতেছে সে কি আর আমি জানি না!”

কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা ভাই, সত্যি করিয়া বলো, দুই দিন যদি বিপিনবাবু তোমাকে দেখা না দেন তা হইলে কি অমনি–”

শৈলজা সগর্বে কহিল, “ইস, দুই দিন দেখা না দিয়া তাঁর নাকি থাকিবার জো আছে!”

এই বলিয়া বিপিনবাবুর অধৈর্য সম্বন্ধে শৈলজা গল্প করিতে লাগিল। প্রথম-প্রথম বিবাহের পর বালক বিপিন গুরুজনের ব্যূহভেদ করিয়া তাহার বালিকাবধূর সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য কবে কতপ্রকার কৌশল উদ্‌ভাবন করিয়াছিল, কবে ব্যর্থ হইয়াছিল, কবে ধরা পড়িয়াছিল, দিবাসাক্ষাৎকারের নিষেধদুঃখ-লাঘবের জন্য বিপিনের মধ্যাহ্নভোজন-কালে একটা আয়নার মধ্যে গুরুজনদের অজ্ঞাতে উভয়ের কিরূপ দৃষ্টিবিনিময় চলিত, তাহা বলিতে বলিতে পুরাতন স্মৃতির আনন্দকৌতুকে শৈলজার মুখখানি হাস্যে উদ্‌ভাসিত হইয়া উঠিল। তাহার পরে যখন আপিসে যাইবার পালা আরম্ভ হইল, তখন উভয়ের বেদনা এবং বিপিনের যখন-তখন আপিস-পলায়ন, সেও অনেক কথা। তাহার পরে একবার শ্বশুরের ব্যবসায়ের খাতিরে কিছুদিনের জন্য বিপিনের পাটনায় যাইবার কথা হয়, তখন শৈলজা তাহার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “তুমি পাটনায় গিয়া থাকিতে পারিবে?’ বিপিন স্পর্ধা করিয়া বলিয়াছিল, “কেন পারিব না, খুব পারিব।’ সেই স্পর্ধাবাক্যে শৈলজার মনে খুব অভিমান হইয়াছিল; সে প্রাণপণে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, বিদায়ের পূর্বরাত্রে সে কোনোমতে লেশমাত্র শোকপ্রকাশ করিবে না; কেমন করিয়া সে প্রতিজ্ঞা হঠাৎ চোখের জলের প্লাবনে ভাসিয়া গেল এবং পরদিনে যখন যাত্রার আয়োজন সমস্তই স্থির তখন বিপিনের অকস্মাৎ এমনি মাথা ধরিয়া কী-এক-রকমের অসুখ করিতে লাগিল যে যাত্রা বন্ধ করিতে হইল, তাহার পরে ডাক্তার যখন ওষুধ দিয়া গেল, তখন সে ওষুধের শিশি গোপনে নর্দমার মধ্যে শূন্য করিয়া অপূর্ব উপায়ে কী করিয়া ব্যাধির অবসান হইল– এ-সমস্ত কাহিনী বলিতে বলিতে কখন যে বেলা অবসান হইয়া আসে, শৈলজার তাহাতে হুঁশ থাকে না– অথচ এমন সময় হঠাৎ দূরে বাহির-দরজায় একটা কিসের শব্দ হয়-কি-না-হয় অমনি শৈল ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া পড়ে। বিপিনবাবু আপিস হইতে ফিরিয়াছেন। সমস্ত গল্পহাসির অন্তরালে একটি উৎকণ্ঠিত হৃদয় সেই পথের ধারের বাহির-দরজার দিকেই কান পাতিয়া বসিয়া ছিল।

কমলার কাছে এ-সমস্ত কথা যে একেবারেই আকাশকুসুমের মতো তাহা নয়; ইহার আভাস সে কিছু-কিছু পাইয়াছে। প্রথম কয়েক মাস রমেশের সহিত প্রথম-পরিচয়ের রহস্যের মধ্যে যেন এই রকমেরই একটা রাগিণী বাজিয়া উঠিতেছিল। তাহার পরেও ইস্কুল হইতে উদ্ধারলাভ করিয়া কমলা যখন রমেশের কাছে ফিরিয়া আসিল তখনো মাঝে মাঝে এমন-সকল ঢেউ অপূর্ব সংগীতে ও অপরূপ নৃত্যে তাহার হৃদয়কে আঘাত করিয়াছে– যাহার ঠিক অর্থটি সে আজ শৈলজার এই-সমস্ত গল্পের মধ্য হইতে বুঝিতে পারিতেছে। কিন্তু তাহার এ-সমস্তই ভাঙাচোরা, ইহার ধারাবাহিকতা কিছুই নাই। তাহাকে যেন কোনো-একটা পরিণাম পর্যন্ত পৌঁছিতে দেওয়া হয় নাই। শৈলজা ও বিপিনের মধ্যে যে-একটা আগ্রহের টান সেটা রমেশ ও তাহার মধ্যে কোথায়? এই-যে কয়েক দিন তাহাদের দেখাশোনা বন্ধ হইয়া আছে তাহাতে তাহার মনের মধ্যে এম্‌নি কি অস্থিরতা উপস্থিত হইয়াছে– এবং রমেশও তাহাকে দেখিবার জন্য বাহিরে বসিয়া বসিয়া কোনো প্রকার কৌশল উদ্‌ভাবন করিতেছে তাহা কোনোমতেই বিশ্বাসযোগ্য নহে।

0 Shares