নৌকা ডুবি

ইতিমধ্যে যেদিন রবিবার আসিল সেদিন শৈলজা কিছু মুশকিলে পড়িল। তাহার নূতন সখীকে দীর্ঘকাল একেবারে একলা পরিত্যাগ করিতে তাহার লজ্জা করিতে লাগিল, অথচ আজ ছুটির দিন একেবারে ব্যর্থ করিবে এতবড়ো ত্যাগশীলতাও তাহার নাই। এ দিকে রমেশবাবু নিকটে থাকিতেও কমলা যখন মিলনে বঞ্চিত হইয়া আছে তখন ছুটির উৎসবে নিজের বরাদ্দ পুরা ভোগ করিতে তাহার ব্যথাও বোধ হইল। আহা, যদি কোনোমতে রমেশের সহিত কমলার সাক্ষাৎ ঘটাইয়া দেওয়া যায়।

এ-সকল বিষয় লইয়া গুরুজনদের সহিত পরামর্শ চলে না। কিন্তু চক্রবর্তী পরামর্শের জন্য অপেক্ষা করিবার লোক নহেন– তিনি বাড়িতে প্রচার করিয়া দিলেন আজ তিনি বিশেষ কাজে শহরের বাহিরে যাইতেছেন। রমেশকে বুঝাইয়া গেলেন যে, বাহিরের লোক আজ কেহ তাঁহার বাড়িতে আসিতেছে না, সদর-দরজা বন্ধ করিয়া তিনি চলিয়া যাইতেছেন। এ খবর তাঁহার কন্যাকেও বিশেষ করিয়া শোনাইয়া দিলেন– নিশ্চয় জানিতেন, কোন্‌ ইঙ্গিতের কী অর্থ, তাহা বুঝিতে শৈলজার বিলম্ব হয় না।

স্নানের পর শৈলজা কমলাকে বলিল, “এসো ভাই, তোমার চুল শুকাইয়া দিই।”

কমলা কহিল, “কেন, আজ এত তাড়াতাড়ি কিসের?”

শৈলজা। সে কথা পরে হইবে, তোমার চুলটা আগে বাঁধিয়া দিই।– বলিয়া কমলার মাথা লইয়া পড়িল। আজ বিনানির সংখ্যা অনেক বেশি, খোঁপা একটা বৃহৎ ব্যাপার হইয়া উঠিল।

তাহার পরে কাপড় লইয়া উভয়ের মধ্যে একটা বিষম তর্ক বাধিয়া গেল। শৈলজা তাহাকে যে রঙিন কাপড় পরাইতে চায় কমলা তাহা পরিবার কারণ খুঁজিয়া পাইল না। অবশেষে শৈলজাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য পরিতে হইল।

মধ্যাহ্নে আহারের পর শৈলজা তাহার স্বামীকে কানে-কানে কী একটা বলিয়া ক্ষণকালের জন্য ছুটি লইয়া আসিল। তাহার পরে কমলাকে বাহিরের ঘরে পাঠাইবার জন্য পীড়াপীড়ি পড়িয়া গেল।

রমেশের কাছে কমলা ইতিপূর্বে অনেক বার অসংকোচে গিয়াছে। এ সম্বন্ধে সমাজে লজ্জাপ্রকাশের যে কোনো বিধান আছে তাহা জানিবার সে কোনো অবসর পায় নাই। পরিচয়ের আরম্ভেই রমেশ সংকোচ ভাঙিয়া দিয়াছিল। নির্লজ্জতার অপবাদ দিয়া ধিক্কার দিবার সঙ্গিনীও তাহার কাছে কেহ ছিল না।

কিন্তু আজ শৈলজার অনুরোধ পালন করা তাহার পক্ষে দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল। স্বামীর কাছে শৈলজা যে-অধিকারে যায় তাহা সে জানিয়াছে; কমলা সেই অধিকারের গৌরব যখন অনুভব করিতেছে না তখন দীনভাবে সে আজ কেমন করিয়া যাইবে!

কমলাকে যখন কিছুতেই রাজি করা গেল না তখন শৈল মনে করিল, রমেশের ‘পরে সে অভিমান করিয়াছে। অভিমান করিবার কথাই বটে। কয়টা দিন কাটিয়া গেল, অথচ রমেশবাবু কোনো ছুতা করিয়া এক বার দেখাসাক্ষাতের চেষ্টাও করিলেন না।

বাড়ির গৃহিণী তখন আহারান্তে ঘরে দুয়ার দিয়া ঘুমাইতেছিলেন। শৈলজা বিপিনকে আসিয়া কহিল, “রমেশবাবুকে তুমি আজ কমলার নাম করিয়া বাড়ির মধ্যেই ডাকিয়া আনো। বাবা কিছু মনে করিবেন না, মা কিছু জানিতেই পারিবেন না।”

বিপিনের মতো চুপচাপ মুখচোরা লোকের পক্ষে এরূপ দৌত্য কোনোমতেই রুচিকর নহে, তথাপি ছুটির দিনে এই অনুরোধ লঙ্ঘন করিতে সে সাহস করিল না।

রমেশ তখন বাহিরের ঘরের জাজিম-পাতা মেজের উপর চিত হইয়া শুইয়া এক পায়ের উচ্ছ্রিত হাঁটুর উপরে আর-এক পা তুলিয়া দিয়া “পায়োনিয়র’ পড়িতেছিল। পাঠ্য অংশ শেষ করিয়া যখন কাজের অভাবে তাহার বিজ্ঞাপনের প্রতি মনোযোগ দিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময় বিপিনকে ঘরে আসিতে দেখিয়া সে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। সঙ্গী হিসাবে বিপিন যে খুব প্রথমশ্রেণীর পদার্থ তাহা না হইলেও বিদেশে মধ্যাহ্নযাপনের পক্ষে রমেশ তাহাকে পরম লাভ বলিয়া গণ্য করিল এবং বলিয়া উঠিল, “আসুন বিপিনবাবু, আসুন, বসুন।”

বিপিন না বসিয়াই একটুখানি মাথা চুলকাইয়া বলিল, “আপনাকে এক বার ইনি ভিতরে ডাকিতেছেন।”

রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “কে, কমলা?”

বিপিন কহিল, “হাঁ।”

রমেশ কিছু আশ্চর্য হইল। রমেশ পূর্বেই স্থির করিয়াছে কমলাকে সে স্ত্রী বলিয়াই গ্রহণ করিবে, কিন্তু তাহার স্বাভাবিক-দ্বিধা-গ্রস্ত মন তৎপূর্বে এই কয়দিন অবকাশ পাইয়া বিশ্রাম করিতেছে। কল্পনায় কমলাকে গৃহিণীপদে অভিষিক্ত করিয়া সে মনকে নানাপ্রকার ভাবী সুখের আশ্বাসে উত্তেজিত করিয়াও তুলিয়াছে, কিন্তু প্রথম আরম্ভটাই দুরূহ। কিছুদিন হইতে কমলার প্রতি যেটুকু দূরত্ব রক্ষা করা তাহার অভ্যস্ত হইয়া গেছে হঠাৎ এক দিন কেমন করিয়া সেটা ভাঙিয়া ফেলিবে, তাহা সে ভাবিয়া পাইতেছিল না; এইজন্যই বাড়িভাড়া করিবার দিকে তাহার তেমন সত্বরতা ছিল না।

কমলা ডাকিয়াছে শুনিয়া রমেশের মনে হইল, নিশ্চয় বিশেষ কোনো একটা প্রয়োজন পড়িয়াছে। তবু প্রয়োজনের ডাক হইলেও তাহার মনের মধ্যে একটা হিল্লোল উঠিল। বিপিনের অনুবর্তী হইয়া “পায়োনিয়র’টা ফেলিয়া রাখিয়া যখন সে অন্তঃপুরে যাত্রা করিল তখন এই মধুকরগুঞ্জরিত কার্তিকের আলস্যদীর্ঘ জনহীন মধ্যাহ্নে একটা অভিসারের আভাস তাহার চিত্তকে একটুখানি চঞ্চল করিল।

বিপিন কিছুদূর হইতে ঘর দেখাইয়া দিয়া চলিয়া গেল। কমলা মনে করিয়াছিল, শৈলজা তাহার সম্বন্ধে হাল ছাড়িয়া দিয়া বিপিনের কাছে চলিয়া গেছে। তাই সে খোলা দরজার চৌকাঠের উপর বসিয়া সামনের বাগানের দিকে চাহিয়া ছিল। শৈল কেমন করিয়া কমলার অন্তরে-বাহিরে একটা ভালোবাসার সুর বাঁধিয়া দিয়াছিল। ঈষত্তপ্ত বাতাসে বাহিরে গাছের পল্লবগুলি যেমন মর্মরশব্দে কাঁপিয়া উঠিতেছিল, কমলার বুকের ভিতরেও মাঝে মাঝে তেমনি একটা দীর্ঘনিশ্বাসের হাওয়া উঠিয়া অব্যক্ত বেদনায় একটি অপরূপ স্পন্দনের সঞ্চার করিতেছিল।

0 Shares