নৌকা ডুবি

চিঠি হইতে বেশ বুঝিতে পারিল, কমলা রমেশের জন্য বিশেষ উদ্‌বেগ প্রকাশ করিতেছে–সে কেবল নিজে লজ্জায় লিখিতে পারে নাই।

ইহাতে রমেশের দ্বিধার দুই শাখা দেখিতে দেখিতে একটাতে আসিয়া মিলিয়া গেল। এখন তো কেবলমাত্র রমেশের সুখদুঃখ লইয়া কথা নয়, কমলাও যে রমেশকে ভালোবাসিয়াছে। বিধাতা যে কেবল নদীর চরের উপরে তাহাদের দুই জনকে মিলাইয়া দিয়াছেন তাহা নহে, হৃদয়ের মধ্যেও এক করিয়াছেন।

এই ভাবিয়া রমেশ আর বিলম্বমাত্র না করিয়া কমলাকে এক চিঠি লিখিয়া বসিল। লিখিল–

প্রিয়তমাসু–

কমলা, তোমাকে এই-যে সম্ভাষণ করিলাম, ইহাকে চিঠি লিখিবার একটা প্রচলিত পদ্ধতিপালন বলিয়া গণ্য করিয়ো না। যদি তোমাকে আজ পৃথিবীতে সকলের চেয়ে প্রিয় বলিয়া না জানিতাম তবে কখনোই আজ “প্রিয়তমা’ বলিয়া সম্ভাষণ করিতে পারিতাম না। যদি তোমার মনে কখনো কোনো সন্দেহ হইয়া থাকে, যদি তোমার কোমল হৃদয়ে কখনো কোনো আঘাত করিয়া থাকি, তবে এই যে আজ সত্য করিয়া তোমাকে ডাকিলাম “প্রিয়তমা’ ইহাতেই আজ তোমার সমস্ত সংশয়, সমস্ত বেদনা নিঃশেষে ক্ষালন করিয়া দিক। ইহার চেয়ে তোমাকে আর বেশি বিস্তারিত করিয়া কী বলিব? এ পর্যন্ত আমার অনেক আচরণ তোমার কাছে নিশ্চয় ব্যথাজনক হইয়াছে–সেজন্য যদি তুমি মনে মনে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করিয়া থাক তবে আমি প্রতিবাদী হইয়া তাহার লেশমাত্র প্রতিবাদ করিব না–আমি কেবল বলিব, আজ তুমি আমার প্রিয়তমা, তোমার চেয়ে প্রিয় আমার আর কেহই নাই। ইহাতেও যদি আমার সমস্ত অপরাধের, সমস্ত অসংগত আচরণের শেষ জবাব না হয়, তবে আর কিছুতেই হইবে না।

অতএব, কমলা, আজ তোমাকে এই “প্রিয়তমা’ সম্বোধন করিয়া আমাদের সংশয়াচ্ছন্ন অতীতকে দূরে সরাইয়া দিলাম, এই “প্রিয়তমা’ সম্বোধন করিয়া আমাদের ভালোবাসার ভবিষ্যৎকে আরম্ভ করিলাম। তোমার কাছে আমার একান্ত মিনতি, তুমি আজ আমার “প্রিয়তমা’ এই কথাটি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করো। ইহা যদি ঠিক তুমি মনে গ্রহণ করিতে পার তবে কোনো সংশয় লইয়া আমাকে আর কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন থাকিবে না।

তাহার পরে, আমি তোমার ভালোবাসা পাইয়াছি কি না, সে কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতে আমার সাহস হয় না। আমি জিজ্ঞাসা করিবও না। আমার এই অনুচ্চারিত প্রশ্নের অনুকূল উত্তর একদিন তোমার হৃদয়ের ভিতর দিয়া আমার হৃদয়ের মধ্যে নিঃশব্দে আসিয়া পৌঁছিবে, ইহাতে আমি সন্দেহমাত্র করি না। ইহা আমি আমার ভালোবাসার জোরে বলিতেছি। আমার যোগ্যতা লইয়া অহংকার করি না, কিন্তু আমার সাধনা কেন সার্থক হইবে না?

আমি বেশ বুঝিতেছি, আমি যাহা লিখিতেছি তাহা কেমন সহজ হইতেছে না, তাহা রচনার মতো শুনাইতেছে। ইচ্ছা করিতেছে, এ চিঠি ছিঁড়িয়া ফেলি। কিন্তু যে চিঠি মনের মতো হইবে সে চিঠি এখনি লেখা সম্ভব হইবে না। কেননা, চিঠি দুজনের জিনিস, কেবল এক পক্ষ যখন চিঠি লেখে তখন সে চিঠিতে সব কথা ঠিক করিয়া লেখা চলে না; তোমাকে আমাতে যেদিন মন-জানাজানির বাকি থাকিবে না সেইদিনই চিঠির মতো চিঠি লিখিতে পারিব; সামনা-সামনি দুই দরজা খোলা থাকিলে তখনি ঘরে অবাধে হাওয়া খেলে। কমলা, প্রিয়তমা, তোমার হৃদয় কবে সম্পূর্ণ উদ্‌ঘাটন করিতে পারিব?

এ-সব কথার মীমাংসা ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে হইবে; ব্যস্ত হইয়া ফল নাই। যেদিন আমার চিঠি পাইবে তাহার পরের দিন সকালবেলাতেই আমি গাজিপুরে পৌঁছিব। তোমার কাছে আমার অনুরোধ এই, গাজিপুরে পৌঁছিয়া আমাদের বাসাতেই যেন তোমাকে দেখিতে পাই। অনেক দিন গৃহহারার মতো কাটিল–আর আমার ধৈর্য নাই– এবারে গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিব, হৃদয়লক্ষ্মীকে গৃহলক্ষ্মীর মূর্তিতে দেখিব। সেই মুহূর্তে দ্বিতীয়বার আমাদের শুভদৃষ্টি হইবে। মনে আছে–আমাদের প্রথমবার সেই শুভদৃষ্টি? সেই জ্যোৎস্নারাত্রে, সেই নদীর ধারে, জনশূন্য বালুমরুর মধ্যে? সেখানে ছাদ ছিল না, প্রাচীর ছিল না, পিতামাতাভ্রাতা-আত্মীয়প্রতিবেশীর সম্বন্ধ ছিল না–সে যে গৃহের একেবারে বাহির। সে যেন স্বপ্ন, সে যেন কিছুই সত্য নহে। সেইজন্য আর-একদিন স্নিগ্ধনির্মল প্রাতঃকালের আলোকে, গৃহের মধ্যে, সত্যের মধ্যে, সেই শুভদৃষ্টিকে সম্পূর্ণ করিয়া লইবার অপেক্ষা আছে। পুণ্যপৌষের প্রাতঃকালে আমাদের গৃহদ্বারে তোমার সরল সহাস্য মুর্তিখানি চিরজীবনের মতো আমার হৃদয়ের মধ্যে অঙ্কিত করিয়া লইব, এইজন্য আমি আগ্রহে পরিপূর্ণ হইয়া আছি। প্রিয়তমে, আমি তোমার হৃদয়ের দ্বারে অতিথি, আমাকে ফিরাইয়ো না–প্রসাদভিক্ষু রমেশ।

৩৭

শৈল ম্লান কমলাকে একটুখানি উৎসাহিত করিয়া তুলিবার জন্য কহিল, “আজ তোমাদের বাংলায় যাইবে না।”

কমলা কহিল, “না, আর দরকার নাই।”

শৈল। তোমার ঘর-সাজানো শেষ হইয়া গেল?

কমলা। হাঁ ভাই, শেষ হইয়া গেছে।

কিছু ক্ষণ পরে আবার শৈল আসিয়া কহিল, “একটা জিনিস যদি দিই তো কী দিবি বল্‌?”

কমলা কহিল, “আমার কী আছে দিদি?”

শৈল। একেবারে কিছুই নাই?

কমলা। কিছুই না।

শৈল কমলার কপোলে করাঘাত করিয়া কহিল, “ইস, তাই তো! যা-কিছু ছিল সমস্ত বুঝি একজনকে সমর্পণ করিয়া দিয়াছিস? এটা কী বল্‌ দেখি।” বলিয়া শৈল অঞ্চলের ভিতর হইতে একটা চিঠি বাহির করিল।

লেফাফায় রমেশের হস্তাক্ষর দেখিয়া কমলার মুখ তৎক্ষণাৎ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল–সে একটুখানি মুখ ফিরাইল।

0 Shares