নৌকা ডুবি

কমলা ব্যস্ত হইয়া কহিল, “না না, মা গিয়া কী করিবেন? সেখানে তো চাকর আছে।”

শৈল হাসিয়া কহিল, “আর তোমার বাহন উমেশ আছে, তোমার ভয় কী?”

উমা তখন কাহার একটা পেনসিল সংগ্রহ করিয়া যেখানে-সেখানে আঁচড় কাটিতেছিল এবং চিৎকার করিয়া অব্যক্ত ভাষা উচ্চারণ করিতেছিল, মনে করিতেছিল “পড়িতেছি।’ শৈল তাহার এই সাহিত্যরচনা হইতে তাহাকে বলপূর্বক কাড়িয়া লইল; সে যখন প্রবল তারস্বরে আপত্তিপ্রকাশ করিল, কমলা বলিল, “একটা মজার জিনিস দিতেছি আয়।”

এই বলিয়া ঘরে লইয়া গিয়া তাহাকে বিছানার উপর ফেলিয়া আদরের দ্বারা তাহাকে অত্যন্ত উদ্‌বেজিত করিয়া তুলিল। সে যখন প্রতিশ্রুত উপহারের দাবি করিল তখন কমলা তাহার বাক্স খুলিয়া একজোড়া সোনার ব্রেসলেট বাহির করিল। এই দুর্লভ খেলনা পাইয়া উমি ভারি খুশি হইল। মাসি তাহার হাতে পরাইয়া দিতেই সে সেই ঢল্‌ঢলে গহনাজোড়া-সমেত দুটি হাতে সন্তর্পণে তুলিয়া ধরিয়া সগর্বে তাহার মাকে দেখাইতে গেল। মা ব্যস্ত হইয়া যথাস্থানে প্রত্যর্পণ করিবার জন্য ব্রেসলেট কাড়িয়া লইল; কহিল, “কমল, তোমার কিরকম বুদ্ধি! এ-সব জিনিস উহার হাতে দাও কেন?”

এই দুর্ব্যবহারে উমির আর্তনাদের নালিশ গগন ভেদ করিয়া উঠিল। কমলা কাছে আসিয়া কহিল, “দিদি, এ ব্রেসলেট-জোড়া আমি উমিকেই দিয়াছি।”

শৈল আশ্চর্য হইয়া কহিল, “পাগল নাকি!”

কমলা কহিল, “আমার মাথা খাও দিদি, এ ব্রেসলেট-জোড়া তুমি আমাকে ফিরাইতে পারিবে না। উহা ভাঙিয়া উমির হার গড়াইয়া দিয়ো।”

শৈল কহিল, “না, সত্য বলিতেছি, তোর মতো খেপা মেয়ে আমি দেখি নাই।”

এই বলিয়া কমলার গলা জড়াইয়া ধরিল। কমলা কহিল, “তোদের এখান হইতে আমি তো আজ চলিলাম দিদি–খুব সুখে ছিলাম–এমন সুখ আমার জীবনে কখনো পাই নাই।” বলিতে বলিতে ঝর ঝর করিয়া তাহার চোখের জল পড়িতে লাগিল।

শৈলও উদ্‌গত অশ্রু দমন করিয়া বলিল, “তোর রকমটা কী বল্‌ দেখি কমল, যেন কত দূরেই যাইতেছিস! যে সুখে ছিলি সে আর আমার বুঝিতে বাকি নাই। এখন তোর সব বাধা দূর হইল, সুখে আপন ঘরে একলা রাজত্ব করিবি–আমরা কখনো গিয়া পড়িলে ভাবিবি, আপদ বিদায় হইলেই বাঁচি।”

বিদায়কালে কমলা শৈলকে প্রণাম করিলে পর শৈল কহিল, “কাল দুপুরবেলা আমি তোদের ওখানে যাইব।”

কমলা তাহার উত্তরে হাঁ-না কিছুই বলিল না।

বাংলায় গিয়া কমলা দেখিল উমেশ আসিয়াছে। কমলা কহিল, “তুই যে! যাত্রা শুনিতে যাবি না?”

উমেশ কহিল, “তুমি যে আজ এখানে থাকিবে, আমি–”

কমলা। আচ্ছা আচ্ছা, সে তোর ভাবিতে হইবে না। তুই যাত্রা শুনিতে যা, এখানে বিষণ আছে। যা, দেরি করিস নে।”

উমেশ। এখনো তো যাত্রার অনেক দেরি।

কমলা। তা হোক-না, বিয়েবাড়িতে কত ধুম হইতেছে, ভালো করিয়া দেখিয়া আয় গে যা।

এ সম্বন্ধে উমেশকে অধিক উৎসাহিত করিবার প্রয়োজন ছিল না। সে চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে কমলা হঠাৎ তাহাকে ডাকিয়া কহিল, “দেখ্‌, খুড়োমশায় আসিলে তুই–”

এইটুকু বলিয়া কথাটা কী করিয়া শেষ করিতে হইবে ভাবিয়া পাইল না। উমেশ হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কমলা খানিক ক্ষণ ভাবিয়া কহিল, “মনে রাখিস, খুড়োমশায় তোকে ভালোবাসেন, তোর যখন যা দরকার হইবে, আমার প্রণাম জানাইয়া তুই তাঁর কাছে চাস, তিনি দিবেন–তাঁকে আমার প্রণাম দিতে কখনো ভুলিস নে–জানিস?”

উমেশ এই অনুশাসনের কোনো অর্থ না বুঝিয়া “যে আজ্ঞে” বলিয়া চলিয়া গেল।

অপরাহ্নে বিষণ জিজ্ঞাসা করিল, “মাজি, কোথায় যাইতেছ?”

কমলা কহিল, “গঙ্গায় স্নান করিতে চলিয়াছি।”

বিষণ কহিল “সঙ্গে যাইব?”

কমলা কহিল, “না, তুই ঘরে পাহারা দে।” বলিয়া তাহার হাতে অনাবশ্যক একটা টাকা দিয়া কমলা গঙ্গার দিকে চলিয়া গেল।

৩৮

একদিন অপরাহ্নে হেমনলিনীর সহিত একত্রে নিভৃতে চা খাইবার প্রত্যাশায় অন্নদাবাবু তাহাকে সন্ধান করিবার জন্য দোতলায় আসিলেন; দোতলায় বসিবার ঘরে তাহাকে খুঁজিয়া পাইলেন না, শুইবার ঘরেও সে নাই। বেহারাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন, হেমনলিনী বাহিরে কোথাও যায় নাই। তখন অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া অন্নদা ছাদের উপরে উঠিলেন।

তখন কলিকাতা শহরের নানা আকার ও আয়তনের বহুদূরবিস্তৃত ছাদগুলির উপরে হেমন্তের অবসন্ন রৌদ্র ম্লান হইয়া আসিয়াছে, দিনান্তের লঘু হাওয়াটি থাকিয়া থাকিয়া যেমন-ইচ্ছা ঘুরিয়া ফিরিয়া যাইতেছে। হেমনলিনী চিলের ছাদের প্রাচীরের ছায়ায় চুপ করিয়া বসিয়া ছিল।

অন্নদাবাবু কখন তাহার পিছনে আসিয়া দাঁড়াইলেন তাহা সে টেরও পাইল না। অবশেষে অন্নদাবাবু যখন আস্তে আস্তে তাহার পাশে আসিয়া তাহার কাঁধে হাত রাখিলেন তখন সে চমকিয়া উঠিল এবং পরক্ষণেই লজ্জায় তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিল। হেমনলিনী তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িবার পূর্বেই অন্নদাবাবু তাহার পাশে বসিলেন। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “হেম, এই সময়ে তোর মা যদি থাকিতেন! আমি তোর কোনো কাজেই লাগিলাম না।”

বৃদ্ধের মুখে এই করুণ উক্তি শুনিবামাত্র হেমনলিনী যেন একটি সুগভীর মূর্ছার ভিতর হইতে তৎক্ষণাৎ জাগিয়া উঠিল। তাহার বাপের মুখের দিকে একবার চাহিয়া দেখিল। সে মুখের উপরে কী স্নেহ, কী করুণা, কী বেদনা! এই কয়দিনের মধ্যে সে মুখের কী পরিবর্তনই হইয়াছে! সংসারে হেমনলিনীকে লইয়া যে ঝড় উঠিয়াছে তাহার সমস্ত বেগ নিজের উপর লইয়া বৃদ্ধ একলা যুঝিতেছেন; কন্যার আহত হৃদয়ের কাছে বার বার ফিরিয়া ফিরিয়া আসিতেছেন; সান্ত্বনা দিবার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হইল দেখিয়া আজ হেমনলিনীর মাকে তাঁহার মনে পড়িতেছে এবং আপন অক্ষম স্নেহের অন্তঃস্তর হইতে দীর্ঘনিশ্বাস উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছে–হঠাৎ হেমনলিনীর কাছে আজ এ-সমস্তই যেন বজ্রের আলোকে প্রকাশ পাইল। ধিক্কারের আঘাতে তাহাকে আপন শোকের পরিবেষ্টন হইতে এক মুহূর্তে বাহির করিয়া আনিল। যে পৃথিবী তাহার কাছে ছায়ার মতো বিলীন হইয়া আসিয়াছিল তাহা এখনি সত্য হইয়া ফুটিয়া উঠিল। হঠাৎ এই মুহূর্তে হেমনলিনীর মতে অত্যন্ত লজ্জার উদয় হইল। যে-সকল স্মৃতির মধ্যে সে একেবারে আচ্ছন্ন হইয়া বসিয়া ছিল সে-সমস্ত বলপূর্বক আপনার চারি দিক হইতে ঝাড়িয়া ফেলিয়া সে আপনাকে মুক্তি দিল। জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, তোমার শরীর এখন কেমন আছে?”

0 Shares