নৌকা ডুবি

হেমনলিনীর মুখে একটা উদ্‌্‌বেগ প্রকাশ পাইল; সে কোনো কথা কহিল না।

যোগেন্দ্র। আমি বলিতেছি, ইহার একটা প্রতিকার না করিলে উনি একটা শক্ত ব্যামোয় পড়িবেন।

হেমনলিনী বুঝিল, পিতার এই অস্বাস্থ্যের জন্য অপরাধ তাহারই উপরে পড়িতেছে। সে মাথা নিচু করিয়া ম্লানমুখে কাপড়ের পাড় লইয়া টানিতে লাগিল।

যোগেন্দ্র কহিল, “যা হইয়া গেছে, সে তো হইয়াই গেছে, তাহা লইয়া যতই আক্ষেপ করিতে থাকিব, ততই আমাদের লজ্জার কথা। এখন বাবার মনকে যদি সম্পূর্ণ সুস্থ করিতে চাও তবে যত শীঘ্র পার এই-সমস্ত অপ্রিয় ব্যাপারের একেবারে গোড়া মারিয়া ফেলিতে হইবে।”

এই বলিয়া উত্তর প্রত্যাশা করিয়া যোগেন্দ্র হেমনলিনীর মুখের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল।

হেম সলজ্জমুখে কহিল, “এ-সমস্ত কথা লইয়া আমি যে কোনোদিন বাবাকে বিরক্ত করিব, এমন সম্ভাবনা নাই।”

যোগেন্দ্র। তুমি তো করিবে না জানি, কিন্তু তাহাতে তো অন্য লোকের মুখ বন্ধ হইবে না।

হেম কহিল, “তা আমি কী করিতে পারি বলো।”

যোগেন্দ্র। চারি দিকে এই যে-সব নানা কথা উঠিয়াছে তাহা বন্ধ করিবার একটিমাত্র উপায় আছে।

যোগেন্দ্র যে উপায় মনে মনে ঠাওরাইয়াছে হেমনলিনী তাহা বুঝিতে পারিয়া তাড়াতাড়ি কহিল, “এখনকার মতো কিছুদিন বাবাকে লইয়া পশ্চিমে বেড়াইতে গেলে ভালো হয় না? দু-চার মাস কাটাইয়া আসিলে ততদিন সমস্ত গোল থামিয়া যাইবে।”

যোগেন্দ্র কহিল, “তাহাতেও সম্পূর্ণ ফল হইবে না। তোমার মনে কোনো ক্ষোভ নাই, যতদিন বাবা এ কথা নিশ্চয় না বুঝিতে পারিবেন ততদিন তাঁহার মনে শেল বিঁধিয়া থাকিবে– ততদিন তাঁহাকে কিছুতেই সুস্থ হইতে দিবে না।”

দেখিতে দেখিতে হেমনলিনীর দুই চোখ জলে ভাসিয়া গেল। সে তাড়াতাড়ি জল মুছিয়া ফেলিল; কহিল, “আমাকে কী করিতে বল।”

যোগেন্দ্র কহিল, “তোমার কানে কঠোর শুনাইবে আমি জানি, কিন্তু সকল দিকের মঙ্গল যদি চাও, তোমাকে কালবিলম্ব না করিয়া বিবাহ করিতে হইবে।”

হেমনলিনী স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। যোগেন্দ্র অধৈর্য সংবরণ করিতে না পারিয়া বলিয়া উঠিল, “হেম, তোমরা কল্পনাদ্বারা ছোটো কথাকে বড়ো করিয়া তুলিতে ভালোবাস। তোমার বিবাহ সম্বন্ধে যেমন গোলমাল ঘটিয়াছে এমন কত মেয়ের ঘটিয়া থাকে, আবার চুকিয়া-বুকিয়া পরিষ্কার হইয়া যায়; নহিলে ঘরের মধ্যে কথায় কথায় নভেল তৈরি হইতে থাকিলে তো লোকের প্রাণ বাঁচে না। “চিরজীবন সন্ন্যাসিনী হইয়া ছাদে বসিয়া আকাশের দিকে তাকাইয়া থাকিব।’ “সেই অপদার্থ মিথ্যাচারীটার স্মৃতি হৃদয়-মন্দিরে স্থাপন করিয়া পূজা করিব’– পৃথিবীর লোকের সামনে এই-সমস্ত কাব্য করিতে তোমার লজ্জা করিবে না, কিন্তু আমরা যে লজ্জায় মরিয়া যাই। ভদ্র গৃহস্থঘরে বিবাহ করিয়া এই-সমস্ত লক্ষ্মীছাড়া কাব্য যত শীঘ্র পার চুকাইয়া ফেলো।”

লোকের চোখের সামনে কাব্য হইয়া উঠিবার লজ্জা যে কতখানি তাহা হেমনলিনী বিলক্ষণ জানে, এইজন্য যোগেন্দ্রের বিদ্রুপবাক্য তাহাকে ছুরির মতো বিঁধিল। সে কহিল, “দাদা, আমি কি বলিতেছি সন্ন্যাসিনী হইয়া থাকিব, বিবাহ করিব না?”

যোগেন্দ্র কহিল, “তাহা যদি না বলিতে চাও তো বিবাহ করো। অবশ্য, তুমি যদি বল স্বর্গরাজ্যের ইন্দ্রদেবকে না হইলে তোমার পছন্দ হইবে না, তাহা হইলে সেই সন্ন্যাসিনীব্রতই গ্রহণ করিতে হয়। পৃথিবীতে মনের মতো কটা জিনিসই বা মেলে, যাহা পাওয়া যায় মনকে তাহারই মতো করিয়া লইতে হয়। আমি তো বলি ইহাতেই মানুষের যথার্থ মহত্ত্ব।”

হেমনলিনী মর্মাহত হইয়া কহিল, “দাদা, তুমি আমাকে এমন করিয়া খোঁটা দিয়া কথা বলিতেছ কেন? আমি কি তোমাকে পছন্দ লইয়া কোনো কথা বলিয়াছি?”

যোগেন্দ্র। বল নাই বটে, কিন্তু আমি দেখিয়াছি, অকারণে এবং অন্যায় কারণে তোমার কোনো কোনো হিতৈষী বন্ধুর উপরে তুমি স্পষ্ট বিদ্বেষ প্রকাশ করিতে কুণ্ঠিত হও না। কিন্তু এ কথা তোমাকে স্বীকার করিতেই হইবে, এ জীবনে যত লোকের সঙ্গে তোমার আলাপ হইয়াছে তাহাদের মধ্যে একজন লোককে দেখা গেছে যে ব্যক্তি সুখে-দুঃখে মানে-অপমানে তোমার প্রতি হৃদয় স্থির রাখিয়াছে। এই কারণে আমি তাহাকে মনে মনে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। তোমাকে সুখী করিবার জন্য জীবন দিতে পারে এমন স্বামী যদি চাও, তবে সে লোককে খুঁজিতে হইবে না। আর যদি কাব্য করিতে চাও তবে–

হেমনলিনী উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “এমন করিয়া তুমি আমাকে বলিয়ো না। বাবা আমাকে যেরূপ আদেশ করিবেন, যাহাকে বিবাহ করিতে বলিবেন, আমি পালন করিব। যদি না করি, তখন তোমার কাব্যের কথা তুলিয়ো।”

যোগেন্দ্র তৎক্ষণাৎ নরম হইয়া কহিল, “হেম, রাগ করিয়ো না বোন। আমার মন খারাপ হইয়া গেলে মাথার ঠিক থাকে না জান তো– তখন যাহা মুখে আসে তাহাই বলিয়া বসি। আমি কি ছেলেবেলা হইতে তোমাকে দেখি নাই, আমি কি জানি না লজ্জা তোমার পক্ষে কত স্বাভাবিক এবং বাবাকে তুমি কত ভালোবাস।”

এই বলিয়া যোগেন্দ্র অন্নদাবাবুর ঘরে চলিয়া গেল। যোগেন্দ্র তাহার বোনের উপর না জানি কিরূপ উৎপীড়ন করিতেছে, তাহাই কল্পনা করিয়া অন্নদা তাঁহার ঘরে উদ্‌বিগ্ন হইয়া বসিয়া ছিলেন; ভাইবোনের কথোপকথনের মাঝখানে গিয়া পড়িবার জন্য উঠি-উঠি করিতেছিলেন, এমন সময় যোগেন্দ্র আসিয়া উপস্থিত হইল– অন্নদা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

0 Shares