নৌকা ডুবি

পিতার পশ্চাতে দাঁড়াইয়া পাকা চুল তুলিবার ছলে মাথায় কোমল অঙ্গুলিগুলি চালনা করিয়া হেম বলিল, “বাবা, চলো আজ সকাল-সকাল চা খাইয়া লইবে। তার পরে তোমার ঘরে বসিয়া তোমার সেকালের গল্প শুনিব– সে-সব কথা আমার কত ভালো লাগে বলিতে পারি না।”

হেমনলিনী সম্বন্ধে অন্নদাবাবুর বোধশক্তি আজকাল এমনি প্রখর হইয়া উঠিয়াছে যে, এই চা খাইতে তাড়া দিবার কারণ বুঝিতে তাঁহার কিছুমাত্র বিলম্ব হইল না। আর কিছু পরেই অক্ষয় চায়ের টেবিলে আসিয়া উপস্থিত হইবে; তাহারই সঙ্গ এড়াইবার জন্য তাড়াতাড়ি চা খাওয়া সারিয়া লইয়া হেম পিতার কক্ষে নিভৃতে আশ্রয় লইতে ইচ্ছা করিয়াছে, ইহা তিনি মুহূর্তেই বুঝিতে পারিলেন। ব্যাধভয়ে ভীত হরিণীর মতো তাঁহার কন্যা যে সর্বদা ত্রস্ত হইয়া আছে, ইহা তাঁহার মনে অত্যন্ত বাজিল।

নীচে গিয়া দেখিলেন, চাকর এখনো চায়ের জল তৈরি করে নাই। তাঁহার উপরে হঠাৎ অত্যন্ত রাগিয়া উঠিলেন; সে বৃথা বুঝাইবার চেষ্টা করিল যে, আজ নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই চায়ের তলব হইয়াছে। চাকররা সব বাবু হইয়া উঠিয়াছে, তাহাদের ঘুম ভাঙাইবার জন্য আবার অন্য লোক রাখার দরকার হইয়াছে, এইরূপ মত তিনি অত্যন্ত নিঃসংশয়ে প্রচার করিলেন।

চাকর তো তাড়াতাড়ি চায়ের জল আনিয়া উপস্থিত করিল। অন্নদাবাবু অন্যদিন যেরূপ গল্প করিতে করিতে ধীরে-সুস্থে আরামে চা-রস উপভোগ করিতেন আজ তাহা না করিয়া অনাবশ্যক সত্বরতার সহিত পেয়ালা নিঃশেষ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। হেমনলিনী কিছু আশ্চর্য হইয়া বলিল, “বাবা, আজ কি তোমার কোথাও বাহির হইবার তাড়া আছে?”

অন্নদাবাবু কহিলেন, “কিছু না, কিছু না। ঠাণ্ডার দিনে গরম চা’টা এক চুমুকে খাইয়া লইলে বেশ ঘামিয়া শরীরটা হালকা হইয়া যায়।”

কিন্তু অন্নদাবাবুর শরীরে ঘর্ম নির্গত হইবার পূর্বেই যোগেন্দ্র অক্ষয়কে লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। আজ অক্ষয়ের বেশভূষায় একটু বিশেষ পারিপাট্য ছিল। হাতে রুপাবাঁধানো ছড়ি, বুকের কাছে ঘড়ির চেন ঝুলিতেছে– বাম হাতে একটা ব্রাউন কাগজে-মোড়া কেতাব। অন্যদিন অক্ষয় টেবিলের যে অংশে বসে আজ সেখানে না বসিয়া হেমনলিনীর অনতিদূরে একটা চৌকি টানিয়া লইল; হাসিমুখে কহিল, “আপনাদের ঘড়ি আজ দ্রুত চলিতেছে।”

হেমনলিনী অক্ষয়ের মুখের দিকে চাহিল না, তাহার কথার উত্তরমাত্র দিল না। অন্নদাবাবু কহিলেন, “হেম, চলো তো মা, উপরে। আমার গরম কাপড়গুলা একবার রৌদ্রে দেওয়া দরকার।”

যোগেন্দ্র কহিল, “বাবা, রৌদ্র তো পালাইতেছে না, এত তাড়াতাড়ি কেন? হেম, অক্ষয়কে এক পেয়ালা চা ঢালিয়া দাও। আমারও চায়ের দরকার আছে, কিন্তু অতিথি আগে।”

অক্ষয় হাসিয়া হেমনলিনীকে কহিল, “কর্তব্যের খাতিরে এতবড়ো আত্মত্যাগ দেখিয়াছেন? দ্বিতীয় সার ফিলিপ-সিড্‌নি।”

হেমনলিনী অক্ষয়ের কথায় লেশমাত্র অবধান প্রকাশ না করিয়া দুই পেয়ালা চা প্রস্তুত করিয়া এক পেয়ালা যোগেন্দ্রকে দিল ও অপর পেয়ালাটি অক্ষয়ের অভিমুখে ঈষৎ একটু ঠেলিয়া দিয়া অন্নদাবাবুর মুখের দিকে তাকাইল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “রৌদ্র বাড়িয়া উঠিলে কষ্ট হইবে, চলো, এইবেলা চলো।”

যোগেন্দ্র কহিল, “আজ কাপড় রৌদ্রে দেওয়া থাক্‌-না। অক্ষয় আসিয়াছে–”

অন্নদা হঠাৎ উদ্দীপ্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “তোমাদের কেবলই জবর্দস্তি। তোমরা কেবল জেদ করিয়া অন্য লোকের মর্মান্তিক বেদনার উপর দিয়া নিজের ইচ্ছাকে জারি করিতে চাও। আমি অনেক দিন নীরবে সহ্য করিয়াছি, কিন্তু আর এরূপ চলিবে না। মা হেম, কাল হইতে উপরে আমার ঘরে তোতে-আমাতে চা খাইব।”

এই বলিয়া হেমকে লইয়া অন্নদা চলিয়া যাইবার উপক্রম করিলে হেম শান্তস্বরে কহিল, “বাবা, আর একটু বোসো। আজ তোমার ভালো করিয়া চা খাওয়া হইল না। অক্ষয়বাবু, কাগজে-মোড়া এই রহস্যটি কী জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?”

অক্ষয় কহিল, “শুধু জিজ্ঞাসা কেন, এ রহস্য উদ্‌ঘাটন করিতেও পারেন।”

এই বলিয়া মোড়কটি হেমনলিনীর দিকে অগ্রসর করিয়া দিল।

হেম খুলিয়া দেখিল, একখানি মরক্কো-বাঁধানো টেনিসন। হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া তাহার মুখ পাণ্ডুবর্ণ হইয়া উঠিল। ঠিক এই টেনিসন, এইরূপ বাঁধানো, সে পূর্বে উপহার পাইয়াছে এবং সেই বইখানি আজও তাহার শোবার ঘরের দেরাজের মধ্যে গোপন সমাদরে রক্ষিত আছে।

যোগেন্দ্র ঈষৎ হাসিয়া কহিল, “রহস্য এখনো সম্পূর্ণ উদ্‌ঘাটিত হয় নাই।”

এই বলিয়া বইয়ের প্রথম শূন্য পাতাটি খুলিয়া তাহার হাতে তুলিয়া দিল। সেই পাতায় লেখা আছে ঃ শ্রীমতী হেমনলিনীর প্রতি অক্ষয়শ্রদ্ধার উপহার।

তৎক্ষণাৎ বইখানা হেমের হাত হইতে একেবারে ভূতলে পড়িয়া গেল– এবং তৎপ্রতি সে লক্ষমাত্র না করিয়া কহিল, “বাবা, চলো।”

উভয়ে ঘর হইতে বাহির হইয়া চলিয়া গেল। যোগেন্দ্রের চোখদুটা আগুনের মতো জ্বলিতে লাগিল। সে কহিল, “না, আমার আর এখানে থাকা পোষাইল না। আমি যেখানে হোক একটা ইস্কুল-মাস্টারি লইয়া এখান হইতে চলিয়া যাইব।”

অক্ষয় কহিল, “ভাই, তুমি মিথ্যা রাগ করিতেছ। আমি তো তখনই সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছিলাম যে তুমি ভুল বুঝিয়াছ। তুমি আমাকে বারংবার আশ্বাস দেওয়াতেই আমি বিচলিত হইয়াছিলাম। কিন্তু আমি নিশ্চয় বলিতেছি আমার প্রতি হেমনলিনীর মন কোনোদিন অনুকূল হইবে না। অতএব সে আশা ছাড়ায়া দাও। কিন্তু আসল কথা এই যে, উনি যাহাতে রমেশকে ভুলিতে পারেন সেটা তোমাদের করা কর্তব্য।”

0 Shares