নৌকা ডুবি

অন্নদাবাবু কহিলেন, “লোকটির ক্ষমতা আছে।”

অক্ষয় কহিল, “শুধু ক্ষমতা! এমন সাধুচরিত্রের লোক দেখা যায় না।”

যোগেন্দ্র যদিও চক্রান্তের মধ্যে ছিল তবু সে থাকিতে না পারিয়া বলিয়া উঠিল, “আঃ, সাধুচরিত্রের কথা আর বলিয়ো না; সাধুসঙ্গ হইতে ভগবান আমাদিগকে পরিত্রাণ করুন।”

যোগেন্দ্র কাল এই নলিনাক্ষের সাধুতার অজস্র প্রশংসা করিয়াছিল, এবং যাহারা নলিনাক্ষের বিরুদ্ধে কথা কহে তাহাদিগকে নিন্দুক বলিয়া গালি দিয়াছিল।

অন্নদা কহিলেন, “ছি যোগেন্দ্র, অমন কথা বলিয়ো না। বাহির হইতে যাঁহাদিগকে ভালো বলিয়া মনে হয় অন্তরেও তাঁহারা ভালো, এ কথা বিশ্বাস করিয়া বরং আমি ঠকিতে রাজি আছি, তবু নিজের ক্ষুদ্র বুদ্ধিমত্তার গৌরবরক্ষার জন্য সাধুতাকে সন্দেহ করিতে আমি প্রস্তুত নই। নলিনাক্ষবাবু যে-সব কথা বলিয়াছেন এ-সমস্ত পরের মুখের কথা নহে; তাঁহার নিজের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার ভিতর হইতে তিনি যাহা প্রকাশ করিয়াছেন আমার পক্ষে আজ তাহা নূতন লাভ বলিয়া মনে হইয়াছে। যে ব্যাক্তি কপট সে ব্যক্তি সত্যকার জিনিস দিবে কোথা হইতে? সোনা যেমন বানানো যায় না এ-সব কথাও তেমনি বানানো যায় না। আমার ইচ্ছা হইয়াছে নলিনাক্ষবাবুকে আমি নিজে গিয়া সাধুবাদ দিয়া আসিব।”

অক্ষয় কহিল, “আমার ভয় হয়, ইঁহার শরীর টেঁকে কি না।”

অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “কেন, ইঁহার শরীর কি ভালো নয়?”

অক্ষয়। ভালো থাকিবার তো কথা নয়; দিনরাত্রি আপনার সাধনা এবং শাস্ত্রালোচনা লইয়াই আছেন, শরীরের প্রতি তো আর দৃষ্টি নাই।

অন্নদা কহিলেন, “এটা ভারি অন্যায়। শরীর নষ্ট করিবার অধিকার আমাদের নাই; আমরা আমাদের শরীর সৃষ্টি করি নাই। আমি যদি উঁহাকে কাছে পাইতাম তবে নিশ্চয়ই অল্পদিনেই আমি উঁহার স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করিয়া দিতে পারিতাম। আসলে স্বাস্থ্যরক্ষার গুটিকতক সহজ নিয়ম আছে, তাহার মধ্যে প্রথম হচ্ছে–”

যোগেন্দ্র অধৈর্য হইয়া কহিল, “বাবা, বৃথা কেন তোমরা ভাবিয়া মরিতেছ? নলিনাক্ষবাবুর শরীর তো দিব্য দেখিলাম; তাঁহাকে দেখিয়া আজ আমার বেশ বোধ হইল, সাধুত্ব-জিনিসটা স্বাস্থ্যকর। আমার নিজেরই মনে হইতেছে, ওটা চেষ্টা করিয়া দেখিলে হয়।”

অন্নদা কহিলেন, “না যোগেন্দ্র, অক্ষয় যাহা বলিতেছে তাহা হইতেও পারে। আমাদের দেশে বড়ো বড়ো লোকেরা প্রায় অল্প বয়সেই মারা যান, ইঁহারা নিজের শরীরকে উপেক্ষা করিয়া দেশের লোকসান করিয়া থাকেন। এটা কিছুতে ঘটিতে দেওয়া উচিত নয়। যোগেন্দ্র, তুমি নলিনাক্ষবাবুকে যাহা মনে করিতেছ তাহা নয়, উঁহার মধ্যে আসল জিনিস আছে। উঁহাকে এখন হইতেই সাবধান করিয়া দেওয়া দরকার।”

অক্ষয়। আমি উঁহাকে আপনার কাছে আনিয়া উপস্থিত করিব। আপনি যদি উঁহাকে একটু ভালো করিয়া বুঝাইয়া দেন তো ভালো হয়। আর, আমার মনে হয়, আপনি সেই-যে শিকড়ের রসটা আমাকে পরীক্ষার সময় দিয়াছিলেন সেটা আশ্চর্য বলকারক। যে-কোনো লোক সর্বদা মনকে খাটাইতেছে তাহার পক্ষে এমন মহৌষধ আর নাই। আপনি যদি একবার নলিনাক্ষবাবুকে–

যোগেন্দ্র একেবারে চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িয়া কহিল, “আঃ অক্ষয়, তুমি জ্বালাইলে। বড়ো বাড়াবাড়ি করিতেছ। আমি চলিলাম।”

৪২

পূর্বে যখন তাঁহার শরীর ভালো ছিল তখন অন্নদাবাবু ডাক্তারি ও কবিরাজি নানাপ্রকার বটিকাদি সর্বদাই ব্যবহার করিতেন– এখন আর ওষুধ খাইবারও উৎসাহ নাই এবং নিজের অস্বাস্থ্য লইয়া আজকাল তিনি আর আলোচনামাত্রও করেন না, বরঞ্চ তাহা গোপন করিতেই চেষ্টা করেন।

আজ তিনি যখন অসময়ে কেদারায় ঘুমাইতেছিলেন তখন সিঁড়িতে পদশব্দ শুনিয়া হেমনলিনী কোল হইতে সেলাইয়ের সামগ্রী নামাইয়া তাহার দাদাকে সতর্ক করিয়া দিবার জন্য দ্বারের কাছে গেল। গিয়া দেখিল, তাহার দাদার সঙ্গে সঙ্গে নলিনাক্ষবাবু আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। তাড়াতাড়ি অন্য ঘরে পালাইবার উপক্রম করিতেই যোগেন্দ্র তাহাকে ডাকিয়া কহিল, “হেম, নলিনাক্ষবাবু আসিয়াছেন, ইঁহার সঙ্গে তোমার পরিচয় করাইয়া দিই।”

হেম থমকিয়া দাঁড়াইল এবং নলিনাক্ষ তাহার সম্মুখে আসিতেই তাহার মুখের দিকে না চাহিয়া নমস্কার করিল। অন্নদাবাবু জাগিয়া উঠিয়া ডাকিলেন, “হেম!” হেম তাঁহার কাছে আসিয়া মৃদুস্বরে কহিল, “নলিনাক্ষবাবু আসিয়াছেন।”

যোগেন্দ্রের সহিত নলিনাক্ষ ঘরে প্রবেশ করিতেই অন্নদাবাবু ব্যস্তভাবে অগ্রসর হইয়া নলিনাক্ষকে অভ্যর্থনা করিয়া আনিলেন। কহিলেন, “আজ আমার বড়ো সৌভাগ্য, আপনি আমার বাড়িতে আসিয়াছেন। হেম, কোথায় যাইতেছ মা, এইখানে বোসো। নলিনাক্ষবাবু, এটি আমার কন্যা হেম– আমরা দুজনেই সেদিন আপনার বক্তৃতা শুনিতে গিয়া বড়ো আনন্দলাভ করিয়া আসিয়াছি। আপনি ঐ-যে একটি কথা বলিয়াছেন– আমরা যাহা পাইয়াছি তাহা কখনোই হারাইতে পারি না, যাহা যথার্থ পাই নাই তাহাই হারাই, এ কথাটির অর্থ বড়ো গভীর। কী বলো মা হেম? বাস্তবিক, কোন্‌ জিনিসটিকে যে আমার করিতে পারিয়াছি আর কোন্‌টিকে পারি নাই তাহার পরীক্ষা হয় তখনি যখনি তাহা আমাদের হাতের কাছ হইতে সরিয়া যায়। নলিনাক্ষবাবু, আপনার কাছে আমাদের একটি অনুরোধ আছে। মাঝে মাঝে আপনি আসিয়া যদি আমাদের সঙ্গে আলোচনা করিয়া যান তবে আমাদের বড়ো উপকার হয়। আমরা বড়ো কোথাও বাহির হই না– আপনি যখনি আসিবেন আমাকে আর আমার মেয়েটিকে এই ঘরেই দেখিতে পাইবেন।”

0 Shares