নৌকা ডুবি

রমেশ দ্বার ঠেলিতেই দ্বার খুলিয়া গেল। ভিতরে গিয়া ঘরে ঘরে ঘুরিয়া দেখিল, কেহ কোথাও নাই। তথাপি একবার উচ্চৈঃস্বরে ডাকিল, “কমলা!” কোথাও কোনো সাড়া পাইল না। বাহিরের বাগানে নিমগাছতলা পর্যন্ত ঘুরিয়া আসিল; রান্নাঘরে, চাকরদের ঘরে, আস্তাবল-ঘরে সন্ধান করিয়া আসিল; কোথাও কমলাকে দেখিতে পাইল না। তখন রৌদ্র উঠিয়া পড়িয়াছে–কাকগুলা ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং বাংলার ইঁদারা হইতে জল লইবার জন্য কলস মাথায় পাড়ার মেয়ে দুই-একজন দেখা দিতেছে। পথের ওপারে কুটিরপ্রাঙ্গণে কোনো পল্লিনারী বিচিত্র উচ্চ সুরে গান গাহিতে গাহিতে জাঁতায় গম ভাঙিতে আরম্ভ করিয়াছে।

রমেশ বাংলাঘরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, বিষন পুনরায় গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন। তখন সে নত হইয়া দুই হাতে খুব করিয়া বিষনকে ঝাঁকানি দিতে লাগিল; দেখিল তাহার নিশ্বাসে তাড়ির প্রবল গন্ধ ছুটিতেছে।

ঝাঁকানির বিষম বেগে বিষন অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। রমেশ পুনর্বার জিজ্ঞাসা করিল, “বহুজি কোথায়?”

বিষন কহিল, “বহুজি তো ঘরেই আছেন।”

রমেশ। কই, ঘরে কোথায়?

বিষন। কাল তো এখানেই আসিয়াছেন।

রমেশ। তাহার পরে কোথায় গেছেন?

বিষন হাঁ করিয়া রমেশের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।

এমন সময় খুব চওড়া পাড়ের এক বাহারে ধুতি পরিয়া চাদর উড়াইয়া রক্তবর্ণচক্ষু উমেশ আসিয়া উপস্থিত হইল। রমেশ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “উমেশ, তোর মা কোথায়?”

উমেশ কহিল, “মা তো কাল হইতে এখানেই আছেন।”

রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “তুই কোথায় ছিলি?”

উমেশ কহিল, “আমাকে মা কাল বিকালে সিধুবাবুদের বাড়ি যাত্রা শুনিতে পাঠাইয়াছিলেন।”

গাড়োয়ান আসিয়া কহিল, “বাবু, আমার ভাড়া।”

রমেশ তাড়াতাড়ি সেই গাড়িতে চড়িয়া একেবারে খুড়ার বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল। সেখানে গিয়া দেখিল, বাড়িসুদ্ধ সকলেই যেন চঞ্চল। রমেশের মনে হইল, কমলার বুঝি কোনো অসুখ করিয়াছে। কিন্তু তাহা নহে। কাল সন্ধ্যার কিছু পরেই উমা হঠাৎ অত্যন্ত চীৎকার করিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল এবং তাহার মুখ নীল ও হাত-পা ঠাণ্ডা হইয়া পড়ায় সকলেই অত্যন্ত ভয় পাইয়া গেল। তাহার চিকিৎসা লইয়া কাল বাড়িসুদ্ধ সকলেই ব্যতিব্যস্ত হইয়া ছিল। সমস্ত রাত কেহ ঘুমাইতে পায় নাই।

রমেশ মনে করিল, উমির অসুখ হওয়াতে নিশ্চয়ই কাল কমলাকে এখানে আনানো হইয়াছিল। বিপিনকে কহিল, “কমলা তা হইলে উমিকে লইয়া খুবই উদ্‌বিগ্ন হইয়া আছে?”

কমলা কাল রাত্রে এখানে আসিয়াছিল কি না বিপিন তাহা নিশ্চয় জানিত না, তাই রমেশের কথায় একপ্রকার সায় দিয়া কহিল, “হাঁ, তিনি উমিকে যেরকম ভালোবাসেন, খুব ভাবিতেছেন বৈকি। কিন্তু ডাক্তার বলিয়াছে, ভাবনার কোনো কারণই নাই।”

যাহা হউক, অত্যন্ত উল্লাসের মুখে কল্পনার পূর্ণ উচ্ছ্বাসে বাধা পাইয়া রমেশের মনটা বিকল হইয়া গেল। সে ভাবিতে লাগিল, তাহাদের মিলনে যেন একটা দৈবের ব্যাঘাত আছে।

এমন সময় রমেশের বাংলা হইতে উমেশ আসিয়া উপস্থিত হইল। এখানকার অন্তঃপুরে তাহার গতিবিধি ছিল। এই বালকটাকে শৈলজা স্নেহও করিত। বাড়ির ভিতরে শৈলজার ঘরের মধ্যে সে প্রবেশ করিতেছে দেখিয়া উমির ঘুম ভাঙিবার আশঙ্কায় শৈল তাড়াতাড়ি ঘরের বাহির হইয়া আসিল।

উমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “মা কোথায় মাসিমা?”

শৈল বিস্মিত হইয়া কহিল, “কেন রে, তুই তো কাল তাহাকে সঙ্গে লইয়া ও বাড়িতে গেলি। সন্ধ্যার পর আমাদের লছমনিয়াকে ওখানে পাঠাইবার কথা ছিল, খুকির অসুখে তাহা পারি নাই।”

উমেশ মুখ ম্লান করিয়া কহিল, “ও বাড়িতে তো তাঁহাকে দেখিলাম না।”

শৈল ব্যস্ত হইয়া কহিল, “সে কী কথা! কাল রাত্রে তুই কোথায় ছিলি?”

উমেশ। আমাকে তো মা থাকিতে দিলেন না। ও বাড়িতে গিয়াই তিনি আমাকে সিধুবাবুদের ওখানে যাত্রা শুনিতে পাঠাইয়াছিলেন।

শৈল। তোরও তো বেশ আক্কেল দেখিতেছি। বিষন কোথায় ছিল?

উমেশ। বিষন তো কিছুই বলিতে পারে না। কাল সে খুব তাড়ি খাইয়াছিল।

শৈল। যা যা, শীঘ্র বাবুকে ডাকিয়া আন্‌।

বিপিন আসিতেই শৈল কহিল, “ওগো, এ কী সর্বনাশ হইয়াছে?”

বিপিনের মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল। সে ব্যস্ত হইয়া কহিল, “কেন, কী হইয়াছে?”

শৈল। কমল কাল ও বাংলায় গিয়াছিল, তাহাকে তো সেখানে খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না।

বিপিন। তিনি কি কাল রাত্রে এখানে আসেন নাই?

শৈল। না গো। উমির অসুখে আনাইব মনে করিয়াছিলাম, লোক কোথায় ছিল? রমেশবাবু কি আসিয়াছেন?

বিপিন। বোধ হয় ও বাংলায় দেখিতে না পাইয়া তিনি ঠিক করিয়াছেন কমলা এখানেই আছেন। তিনি তো আমাদের এখানেই আসিয়াছেন।

শৈল। যাও যাও, শীঘ্র যাও, তাঁহাকে লইয়া খোঁজ করো গে। উমি এখন ঘুমাইতেছে–সে ভালোই আছে।

বিপিন ও রমেশ আবার সেই গাড়িতে উঠিয়া বাংলায় ফিরিয়া গেল এবং বিষনকে লইয়া পড়িল। অনেক চেষ্টায় জোড়াতাড়া দিয়া যেটুকু খবর বাহির হইল তাহা এই–কাল বৈকালে কমলা একলা গঙ্গার ধারের অভিমুখে চলিয়াছিল। বিষন তাহার সঙ্গে যাইবার প্রস্তাব করে, কমলা তাহার হাতে একটা টাকা দিয়া তাহাকে নিষেধ করিয়া ফিরাইয়া দেয়। সে পাহারা দিবার জন্য বাগানের গেটের কাছে বসিয়া ছিল, এমন সময়ে গাছ হইতে সদ্যঃসঞ্চিত ফেনোচ্ছল তাড়ির কলস বাঁকে করিয়া তাড়িওয়ালা তাহার সম্মুখ দিয়া চলিয়া যাইতেছিল–তাহার পর হইতে বিশ্বসংসারে কী যে ঘটিয়াছে তাহা বিষনের কাছে যথেষ্ট স্পষ্ট নহে। যে পথ দিয়া কমলাকে গঙ্গার দিকে যাইতে দেখিয়াছিল বিষন তাহা দেখাইয়া দিল।

0 Shares