নৌকা ডুবি

সেই পথ অবলম্বন করিয়া শিশিরসিক্ত শস্যক্ষেত্রের মাঝখান দিয়া রমেশ বিপিন ও উমেশ কমলার সন্ধানে চলিল। উমেশ হৃতশাবক শিকারি জন্তুর মতো চারি দিকে তীক্ষ্ণ ব্যাকুল দৃষ্টি প্রেরণ করিতে লাগিল। গঙ্গার তটে আসিয়া তিন জনে একবার দাঁড়াইল। সেখানে চারি দিক উন্মুক্ত। ধূসর বালুকা প্রভাতরৌদ্রে ধু-ধু করিতেছে। কোথাও কাহাকেও দেখা গেল না। উমেশ উচ্চকণ্ঠে চীৎকার করিয়া ডাকিল, “মা, মা গো, মা কোথায়?” ও পারের সুদূর উচ্চতীর হইতে তাহার প্রতিধ্বনি ফিরিয়া আসিল–কেহই সাড়া দিল না।

খুঁজিতে খুঁজিতে উমেশ হঠাৎ দূরে সাদা কী একটা দেখিতে পাইল। তাড়াতাড়ি কাছে আসিয়া দেখিল, জলের একেবারে ধারেই এক গোছা চাবি একটা রুমালে বাঁধা পড়িয়া আছে। “কি রে ওটা কী?” বলিয়া রমেশও আসিয়া পড়িল। দেখিল, কমলারই চাবির গোছা।

যেখানে চাবি পড়িয়াছিল সেখানে বালুতটের প্রান্তভাগে পলিমাটি পড়িয়াছে। সেই কাঁচা মাটির উপর দিয়া গঙ্গার জল পর্যন্ত ছোটো দুইটি পায়ের গভীর চিহ্ন পড়িয়া গেছে। খানিকটা জলের মধ্যে একটা কী ঝিক্‌ ঝিক্‌ করিতেছিল, তাহা উমেশের দৃষ্টি এড়াইতে পারিল না; সে সেটা তাড়াতাড়ি তুলিয়া ধরিতেই দেখা গেল, সোনার উপরে এনামেল-করা একটি ছোটো ব্রোচ–ইহা রমেশেরই উপহার।

এইরূপে সমস্ত সংকেতই যখন গঙ্গার জলের দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করিল তখন উমেশ আর থাকিতে পারিল না–“মা, মা গো” বলিয়া চীৎকার করিয়া জলের মধ্যে ঝাঁপ দিয়া পড়িল। জল সেখানে অধিক ছিল না; উমেশ বারংবার পাগলের মতো ডুব দিয়া তলা হাৎড়াইয়া বেড়াইতে লাগিল, জল ঘোলা করিয়া তুলিল।

রমেশ হতবুদ্ধির মতো দাঁড়াইয়া রহিল। বিপিন কহিল, “উমেশ, তুই কী করিতেছিস? উঠিয়া আয়।”

উমেশ মুখ দিয়া জল ফেলিতে ফেলিতে বলিতে লাগিল, “আমি উঠিব না, আমি উঠিব না। মা গো, তুমি আমাকে ফেলিয়া যাইতে পারিবে না।”

বিপিন ভীত হইয়া উঠিল। কিন্তু উমেশ জলের মাছের মতো সাঁতার দিতে পারে, তাহার পক্ষে জলে আত্মহত্যা করা অত্যন্ত কঠিন। সে অনেকটা হাঁপাইয়া-ঝাঁপাইয়া শ্রান্ত হইয়া ডাঙায় উঠিয়া পড়িল এবং বালুর উপরে লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল।

বিপিন নিস্তব্ধ রমেশকে স্পর্শ করিয়া কহিল, “রমেশবাবু, চলুন। এখানে দাঁড়াইয়া থাকিয়া কী হইবে! একবার পুলিসকে খবর দেওয়া যাক, তাহারা সমস্ত সন্ধান করিয়া দেখুক।”

শৈলজার ঘরে সেদিন আহারনিদ্রা বন্ধ হইয়া কান্নার রোল উঠিল। নদীতে জেলেরা নৌকা লইয়া অনেক দূর পর্যন্ত জাল টানিয়া বেড়াইল। পুলিস চারি দিকে সন্ধান করিতে লাগিল। স্টেশনে গিয়া বিশেষ করিয়া খবর লইল, কমলার সহিত বর্ণনায় মেলে এমন কোনো বাঙালির মেয়ে রাত্রে রেলগাড়িতে ওঠে নাই।

সেই দিনই বিকালে খুড়া আসিয়া পৌঁছিলেন। কয়দিন হইতে কমলার ব্যবহার ও আদ্যোপান্ত সমুদয় বৃত্তান্ত শুনিয়া তাঁহার সন্দেহমাত্র রহিল না যে, কমলা গঙ্গার জলে ডুবিয়া আত্মহত্যা করিয়া মরিয়াছে।

লছমনিয়া কহিল, “সেইজন্যই খুকি কাল রাত্রে অকারণে কান্না জুড়িয়া এমন একটা অদ্ভুত কাণ্ড করিল, উহাকে ভালো করিয়া ঝাড়াইয়া লওয়া দরকার।”

রমেশের বুকের ভিতরটা যেন শুকাইয়া গেল; তাহার মধ্যে অশ্রুর বাষ্পটুকুও ছিল না। সে বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল–“একদিন এই কমলা এই গঙ্গার জল হইতে উঠিয়া আমার পাশে আসিয়াছিল, আবার পূজার পবিত্র ফুলটুকুর মতো আর-এক দিন এই গঙ্গার জলের মধ্যেই অন্তর্হিত হইল।”

সূর্য যখন অস্ত গেল তখন রমেশ আবার সেই গঙ্গার ধারে আসিল; যেখানে চাবির গোছা পড়িয়া ছিল সেখানে দাঁড়াইয়া সেই পায়ের চিহ্ন ক’টি একদৃষ্টে দেখিল; তাহার পরে তীরে জুতা খুলিয়া, ধুতি গুটাইয়া লইয়া, খানিকটা জল পর্যন্ত নামিয়া গেল এবং বাক্স হইতে সেই নূতন নেকলেসটি বাহির করিয়া দূরে জলের মধ্যে ছুঁড়িয়া ফেলিল।

রমেশ কখন যে গাজিপুর হইতে চলিয়া গেল, খুড়ার বাড়িতে তাহার খবর লইবার মতো অবস্থা কাহারো রহিল না।

৪৬

এখন রমেশের সম্মুখে কোনো কাজ রহিল না। তাহার মনে হইতে লাগিল, ইহজীবনে সে যেন কোনো কাজ করিবে না, কোথাও স্থায়ী হইয়া বসিতে পারিবে না। হেমনলিনীর কথা তাহার মনে একেবারেই যে উঠে নাই তাহা নহে, কিন্তু তাহা সে সরাইয়া দিয়াছে; সে মনে মনে বলিয়াছে, “আমার জীবনে যে নিদারুণ ঘটনা আঘাত করিল তাহাতে আমাকে চিরদিনের জন্য সংসারের অযোগ্য করিয়া তুলিয়াছে। বজ্রাহত গাছ প্রফুল্ল উপবনের মধ্যে স্থান পাইবার আশা কেন করিবে?’

রমেশ ভ্রমণ করিয়া বেড়াইবার জন্য বাহির হইল। এক জায়গায় কোথাও বেশি দিন রহিল না। সে নৌকায় চড়িয়া কাশীর ঘাটের শোভা দেখিল, সে দিল্লিতে কুতবমিনরের উপরে চড়িল, আগ্রায় জ্যোৎস্না-রাত্রে তাজ দেখিয়া আসিল। অমৃতসরে গুরুদরবার দেখিয়া রাজপুতানায় আবুপর্বতশিখরে মন্দির দেখিতে গেল–এমনি করিয়া রমেশ নিজের শরীর-মনকে আর বিশ্রাম দিল না।

অবশেষে এই ভ্রমণশ্রান্ত যুবকটির অন্তঃকরণ কেবল ঘর চাহিয়া হা হা করিতে লাগিল। তাহার মনে একটি শান্তিময় ঘরের অতীত স্মৃতি ও একটি সম্ভবপর ঘরের সুখময় কল্পনা কেবলই আঘাত দিতেছে। অবশেষে একদিন তাহার শোককাল-যাপনের ভ্রমণ হঠাৎ শেষ হইয়া গেল এবং সে একটা মস্ত দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কলিকাতার টিকিট কিনিয়া রেলগাড়িতে উঠিয়া পড়িল।

0 Shares