নৌকা ডুবি

কলিকাতায় পৌঁছিয়া রমেশ সেই কলুটোলার গলিটার ভিতরে হঠাৎ প্রবেশ করিতে পারিল না। সেখানে গিয়া সে কী দেখিবে, কী শুনিবে, তাহার কিছুই ঠিকানা নাই। মনের মধ্যে কেবলই একটা আশঙ্কা হইতে লাগিল যে, সেখানে একটা গুরুতর পরিবর্তন হইয়াছে। একদিন তো সে গলির মোড় পর্যন্ত গিয়া ফিরিয়া আসিল। পরদিন সন্ধ্যাবেলা রমেশ নিজেকে জোর করিয়া সেই বাড়ির সম্মুখে উপস্থিত করিল। দেখিল, বাড়ির সমস্ত দরজা-জানলা বন্ধ, ভিতরে কোনো লোক আছে এমন লক্ষণ নাই। তবু সেই সুখন-বেহারাটা হয়তো শূন্য বাড়ি আগলাইতেছে মনে করিয়া রমেশ বেহারাকে ডাকিয়া দ্বারে বারকতক আঘাত করিল। কেহ সাড়া দিল না। প্রতিবেশী চন্দ্রমোহন তাহার ঘরের বাহিরে বসিয়া তামাক খাইতেছিল; সে কহিল, “কে ও। রমেশবাবু নাকি। ভালো আছেন তো? এ বাড়িতে অন্নদাবাবুরা তো এখন কেহ নাই।”

রমেশ। তাঁহারা কোথায় গেছেন জানেন?

চন্দ্র। সে খবর তো বলিতে পারি না, পশ্চিমে গেছেন এই জানি।

রমেশ। কে কে গেছেন মশায়?

চন্দ্র। অন্নদাবাবু আর তাঁর মেয়ে।

রমেশ। ঠিক জানেন, তাঁহাদের সঙ্গে আর কেহ যান নাই?

চন্দ্র। ঠিক জানি বৈকি। যাইবার সময়ও আমার সঙ্গে দেখা হইয়াছে।

তখন রমেশ ধৈর্যরক্ষায় অক্ষম হইয়া কহিল, “আমি একজনের কাছে খবর পাইয়াছি, নলিনবাবু বলিয়া একটি বাবু তাঁহাদের সঙ্গে গেছেন।”

চন্দ্র। ভুল খবর পাইয়াছেন। নলিনবাবু আপনার ঐ বাসাটাতেই দিন-কয়েক ছিলেন। ইঁহারা যাত্রা করিবার দিন-দুইচার পূর্বেই তিনি কাশীতে গেছেন।

রমেশ তখন এই নলিনবাবুটির বিবরণ প্রশ্ন করিয়া করিয়া চন্দ্রমোহনের কাছ হইতে বাহির করিল। ইঁহার নাম নলিনাক্ষ চট্টোপাধ্যায়। শোনা গেছে, পূর্বে রংপুরে ডাক্তারি করিতেন, এখন মাকে লইয়া কাশীতেই আছেন। রমেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল। জিজ্ঞাসা করিল, যোগেন এখন কোথায় আছে বলিতে পারেন?”

চন্দ্রমোহন খবর দিল, যোগেন্দ্র ময়মন্‌সিঙের একটি জমিদারের স্থাপিত হাই-স্কুলের হেড্‌মাস্টার-পদে নিযুক্ত হইয়া বিশাইপুরে গিয়াছে।

চন্দ্রমোহন জিজ্ঞাসা করিল, “রমেশবাবু, আপনাকে তো অনেকদিন দেখি নাই; আপনি এতকাল কোথায় ছিলেন?”

রমেশ আর গোপন করবার কারণ দেখিল না; সে কহিল, “প্র৻াকটিস করিতে গাজিপুরে গিয়াছিলাম।”

চন্দ্র। এখন তবে কি সেইখানেই থাকা হইবে?

রমেশ। না, সেখানে আমার থাকা হইল না; এখন কোথায় যাইব ঠিক করি নাই।

রমেশ চলিয়া যাইবার অনতিকাল পরেই অক্ষয় আসিয়া উপস্থিত হইল। যোগেন্দ্র চলিয়া যাইবার সময়, মাঝে মাঝে তাহাদের বাড়ির তত্ত্বাবধানের জন্য অক্ষয়ের উপর ভার দিয়া গিয়াছিল। অক্ষয় যে ভার গ্রহণ করে তাহা রক্ষা করিতে কখনো শৈথিল্য করে না; তাই সে হঠাৎ যখন-তখন আসিয়া দেখিয়া যায়, বাড়ির বেহারা দুজনের মধ্যে একজনও হাজির থাকিয়া খবরদারি করিতেছে কি না।

চন্দ্রমোহন তাহাকে কহিল, “রমেশবাবু এই খানিকক্ষণ হইল এখান হইতে চলিয়া গেলেন।”

অক্ষয়। বলেন কী! কী করিতে আসিয়াছিলেন?

চন্দ্র। তাহা তো জানি না। আমার কাছে অন্নদাবাবুদের সমস্ত খবর জানিয়া লইলেন। এমন রোগা হইয়া গেছেন, হঠাৎ তাঁহাকে চেনাই কঠিন; যদি বেহারাকে না ডাকিতেন আমি চিনিতে পারিতাম না।

অক্ষয়। এখন কোথায় থাকেন, খবর পাইলেন?

চন্দ্র। এতদিন গাজিপুরে ছিলেন; এখন সেখান হইতে উঠিয়া আসিয়াছেন, কোথায় থাকিবেন ঠিক করিয়া বলিতে পারিলেন না।

অক্ষয় বলিল, “ও” বলিয়া আপন কর্মে মন দিল।

রমেশ বাসায় ফিরিয়া আসিয়া ভাবিতে লাগিল, “অদৃষ্ট এ কী বিষম কৌতুকে প্রবৃত্ত হইয়াছে। এক দিকে আমার সঙ্গে কমলার ও অন্য দিকে নলিনাক্ষের সঙ্গে হেমনলিনীর এই মিলন, এ যে একেবারে উপন্যাসের মতো–সেও কুলিখিত উপন্যাস। এমনতরো ঠিক উল্‌টাপাল্‌টা মিল করিয়া দেওয়া অদৃষ্টেরই মতো বে-পরোয়া রচয়িতার পক্ষেই সম্ভব–সংসারে সে এমন অদ্ভুত কাণ্ড ঘটায় যাহা ভীরু লেখক কাল্পনিক উপাখ্যানে লিখিতে সাহস করে না।’ কিন্তু রমেশ ভাবিল, এবার সে যখন তাহার জীবনের সমস্যাজাল হইতে মুক্ত হইয়াছে, তখন খুব সম্ভব, অদৃষ্ট এই জটিল উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে রমেশের পক্ষে নিদারুণ উপসংহার লিখিবে না।

যোগেন্দ্র বিশাইপুর জমিদার-বাড়ির নিকটবর্তী একটি একতলা বাড়িতে বাসা পাইয়াছিল; সেখানে রবিবার সকালে খবরের কাগজ পড়িতেছিল এমন সময় বাজারের একটি লোক তাহার হাতে একখানি চিঠি দিল। খামের উপরকার অক্ষর দেখায়াই সে আশ্চর্য হইয়া গেল। খুলিয়া দেখিল রমেশ লিখিয়াছে–সে বিশাইপুরের একটি দোকানে অপেক্ষা করিতেছে, বিশেষ কয়েকটি কথা বলিবার আছে।

যোগেন্দ্র একেবারে চৌকি ছাড়িয়া লাফাইয়া উঠিল। রমেশকে যদিও সে একদিন অপমান করিতে বাধ্য হইয়াছিল তবু সেই বাল্যবন্ধুকে এই দূরদেশে এতদিন অদর্শনের পরে ফিরাইয়া দিতে পারিল না। এমন-কি, তাহার মনের মধ্যে একটা আনন্দই হইল, কৌতূহলও কম হইল না। বিশেষত হেমনলিনী যখন কাছে নাই, তখন রমেশের দ্বারা কোনো অনিষ্টের আশঙ্কা করা যায় না।

পত্রবাহকটিকে সঙ্গে করিয়া যোগেন্দ্র নিজেই রমেশের সন্ধানে চলিল। দেখিল, সে একটি মুদির দোকানে একটা শূন্য কেরোসিনের বাক্স খাড়া করিয়া তাহার উপরে চুপ করিয়া বসিয়া আছে; মুদি ব্রাহ্মণের হুঁকায় তাহাকে তামাক দিতে প্রস্তুত হইয়াছিল, কিন্তু চশমা-পরা বাবুটি তামাক খায় না শুনিয়া মুদি তাহাকে শহরজাত কোনো অদ্ভুতশ্রেণীর পদার্থের মধ্যে গণ্য করিয়াছিল। সেই অবধি পরস্পরের মধ্যে কোনোপ্রকার আলাপ-পরিচয়ের চেষ্টা হয় নাই।

0 Shares