নৌকা ডুবি

এই বলিয়া সে তাহার রুমালে বাঁধা চাবির গোছা সেইখানেই ফেলিল এবং হঠাৎ তাহার মনে পড়িল, রমেশের দেওয়া একটা ব্রোচ তাহার কাপড়ে বেঁধানো আছে। সেটা তাড়াতাড়ি খুলিয়া জলের মধ্যে ফেলিয়া দিল। তাহার পরে পশ্চিমে মুখ করিয়া সে চলিতে আরম্ভ করিল–কোথায় যাইবে, কী করিবে, তাহা তাহার মনে স্পষ্ট ছিল না; কেবল সে জানিয়াছিল, তাহাকে চলিতেই হইবে, এখানে তাহার এক মুহূর্ত দাঁড়াইবার স্থান নাই।

শীতের দিনান্তের আলোকটুকু নিঃশেষ হইয়া যাইতে বিলম্ব হইল না। অন্ধকারের মধ্যে সাদা বালুতট অস্পষ্টভাবে ধূ ধূ করিতে লাগিল, হঠাৎ এক জায়গায় কে যেন বিচিত্র রচনাবলীর মাঝখান হইতে সৃষ্টির খানিকটা চিত্রলেখা একেবারে মুছিয়া ফেলিয়াছে। কৃষ্ঞপক্ষের অন্ধকার রাত্রি তাহার সমস্ত নির্নিমেষ তারা লইয়া এই জনশূন্য নদীতীরের উপর অতি ধীরে নিশ্বাস ফেলিতে লাগিল।

কমলা সম্মুখে গৃহহীন অনন্ত অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখিতে পাইল না, কিন্তু সে জানিল, তাহাকে চলিতেই হইবে–কোথাও পৌঁছিবে কি না তাহা ভাবিবার সামর্থ্যও তাহার নাই।

বরাবর নদীর ধার দিয়া সে চলিবে, এই সে স্থির করিয়াছে; তাহা হইলে কাহাকেও পথ জিজ্ঞাসা করিতে হইবে না এবং যদি বিপদ তাহাকে আক্রমণ করে, তবে মুহূর্তের মধ্যেই মা গঙ্গা তাহাকে আশ্রয় দিবেন।

আকাশে কুহেলিকার লেশমাত্র ছিল না। অনাবিল অন্ধকার কমলাকে আবৃত করিয়া রাখিল, কিন্তু তাহার দৃষ্টিকে বাধা দিল না।

রাত্রি বাড়িতে লাগিল। যবের খেতের প্রান্ত হইতে শৃগাল ডাকিয়া গেল। কমলা বহুদূর চলিতে চলিতে বালুর চর শেষ হইয়া মাটির ডাঙা আরম্ভ হইল। নদীর ধারেই একটা গ্রাম দেখা গেল। কমলা কম্পিতবক্ষে গ্রামের কাছে আসিয়া দেখিল, গ্রামটি সুষুপ্ত। ভয়ে ভয়ে গ্রামটি পার হইয়া চলিতে চলিতে তাহার শরীরে আর শক্তি রহিল না। অবশেষে এক জায়গায় এমন একটা ভাঙাতটের কাছে আসিয়া পৌঁছিল যেখানে সম্মুখে আর কোনো পথ পাইল না। নিতান্ত অশক্ত হইয়া একটা বটগাছের তলায় শুইয়া পড়িল, শুইবামাত্রই কখন নিদ্রা আসিল জানিতেও পারিল না।

প্রত্যুষেই চোখ মেলিয়া দেখিল, কৃষ্ঞপক্ষের চাঁদের আলোকে অন্ধকার ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে এবং একটি প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেছে, “তুমি কে গা? শীতের রাত্রে এই গাছের তলায় কে শুইয়া?”

কমলা চকিত হইয়া উঠিয়া বসিল। দেখিল, তাহার অদূরে ঘাটে দুখানা বজরা বাঁধা রহিয়াছে–এই প্রৌঢ়াটি লোক উঠিবার পূর্বেই স্নান সারিয়া লইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছেন।

প্রৌঢ়া কহিলেন, “হাঁ গা, তোমাকে যে বাঙালির মতো দেখিতেছি।”

কমলা কহিল, “আমি বাঙালি।”

প্রৌঢ়া। এখানে পড়িয়া আছ যে?

কমলা। আমি কাশীতে যাইব বলিয়া বাহির হইয়াছি। রাত অনেক হইল, ঘুম আসিল, এইখানেই শুইয়া পড়িলাম।

প্রৌঢ়া। ওমা, সে কী কথা! হাঁটিয়া কাশী যাইতেছ? আচ্ছা চলো, ঐ বজরায় চলো, আমি স্নান সারিয়া আসিতেছি।

স্নানের পর এই স্ত্রীলোকটির সহিত কমলার পরিচয় হইল।

গাজিপুরে যে সিদ্ধেশ্বরবাবুদের বাড়িতে খুব ঘটা করিয়া বিবাহ হইতেছিল, তাঁহারা ইঁহাদের আত্মীয়। এই প্রৌঢ়াটির নাম নবীনকালী। এবং ইঁহার স্বামীর নাম মুকুন্দলাল দত্ত–কিছুকাল কাশীতেই বাস করিতেছেন। ইাঁহারা আত্মীয়ের বাড়ি নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করিতে পারেন নাই, অথচ পাছে তাঁহাদের বাড়িতে থাকিতে বা খাইতে হয় এইজন্য বোটে করিয়া গিয়াছিলেন। বিবাহবাড়ির কর্ত্রী ক্ষোভপ্রকাশ করাতে নবীনকালী বলিয়াছিলেন, “জানই তো ভাই, কর্তার শরীর ভালো নয়। আর ছেলেবেলা হইতে উঁহাদের অভ্যাসই একরকম। বাড়িতে গোরু রাখিয়া দুধ হইতে মাখন তুলিয়া সেই মাখন-মারা ঘিয়ে উঁহার লুচি তৈরি হয়–আবার সে গোরুকে যা-তা খাওয়াইলে চলিবে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

নবীনকালী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কী?”

কমলা কহিল, “আমার নাম কমলা।”

নবীনকালী। তোমার হাতে লোহা দেখিতেছি, স্বামী আছে বুঝি?

কমলা কহিল, “বিবাহের পরদিন হইতেই স্বামী নিরুদ্দেশ হইয়া গেছেন।”

নবীনকালী। ওমা, সে কী কথা! তোমার বয়স তো বড়ো বেশি বোধ হয় না।

তাহাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, “পনেরোর বেশি হইবে না।”

কমলা কহিল, “বয়স ঠিক জানি না, বোধ করি, পনেরোই হইবে।”

নবীনকালী। তুমি ব্রাহ্মণের মেয়ে বটে?

কমলা কহিল, “হাঁ।”

নবীনকালী কহিলেন, “তোমাদের বাড়ি কোথায়?”

কমলা। কখনো শ্বশুরবাড়ি যাই নাই, আমার বাপের বাড়ি বিশুখালি।

কমলার পিত্রালয় বিশুখালিতেই ছিল, তাহা সে জানিত।

নবীনকালী। তোমার বাপ-মা–

কমলা। আমার বাপ-মা কেহই নাই।

নবীনকালী। হরি বলো! তবে তুমি কী করিবে?

কমলা। কাশীতে যদি কোনো ভদ্র গৃহস্থ আমাকে বাড়িতে রাখিয়া দু-বেলা দুটি খাইতে দেন, তবে আমি কাজ করিব। আমি রাঁধিতে পারি।

নবীনকালী বিনা-বেতনে পাচিকা ব্রাহ্মণী লাভ করিয়া মনে মনে ভারি খুশি হইলেন। কহিলেন, “আমাদের তো দরকার নাই–বামুন-চাকর সমস্তই আমাদের সঙ্গে আছে। আমাদের আবার যে-সে বামুন হইবার জো নাই–কর্তার খাবারের একটু এদিক-ওদিক হইলে আর কি রক্ষা আছে। বামুনকে মাইনে দিতে হয় চৌদ্দ টাকা, তার উপরে ভাত-কাপড় আছে। তা হোক, ব্রাহ্মণের মেয়ে, তুমি বিপদে পড়িয়াছ–তা, চলো, আমাদের ওখানেই চলো। কত লোক খাচ্ছে-দাচ্ছে, কত ফেলা-ছড়া যায়, আর-এক জন বাড়িলে কেহ জানিতেও পারিবে না। আমাদের কাজও তেমন বেশি নয়। এখানে কেবল কর্তা আর আমি আছি। মেয়েগুলির সব বিবাহ দিয়াছি; তা, তাহারা বেশ বড়ো ঘরেই পড়িয়াছে। আমার একটিমাত্র ছেলে, সে হাকিম, এখন সেরাজগঞ্জে আছে, লাট-সাহেবের ওখান হইতে দু-মাস অন্তর তাহার নামে চিঠি আসে। আমি কর্তাকে বলি, আমাদের নোটোর তো অভাব কিছুই নাই, কেন তাহার এই গেরো। এতবড়ো হাকিমি সকলের ভাগ্যে জোটে না, তা জানি, কিন্তু বাছাকে তবু তো সেই বিদেশে পড়িয়া থাকিতে হয়। কেন? দরকার কী? কর্তা বলেন, “ওগো সেজন্য নয়, সেজন্য নয়। তুমি মেয়েমানুষ, বোঝ না। আমি কি রোজগারের জন্য নোটোকে চাকরিতে দিয়াছি? আমার অভার কিসের? তবে কিনা, হাতে একটা কাজ থাকা চাই, নহিলে অল্প বয়স, কি জানি কখন কী মতি হয়।’

0 Shares