নৌকা ডুবি

সন্ধ্যার সময় ডাক্তারের উপদেশমত অন্নদাবাবুকে জারকচূর্ণমিশ্রিত দুগ্ধ পান করাইয়া হেমনলিনী তাঁহার কাছে বসিল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “আলোটা চোখের সামনে হইতে সরাইয়া দাও।”

ঘর একটু অন্ধকার হইলে অন্নদাবাবু কহিলেন, “সকালবেলায় যে বৃদ্ধটি আসিয়া-ছিলেন তাঁহাকে দেখিয়া বেশ সরল বোধ হইল।”

হেমনলিনী এই প্রসঙ্গ লইয়া কোনো কথা কহিল না, চুপ করিয়া রহিল। অন্নদাবাবু আর অধিক ভূমিকা বানাইতে পারিলেন না। তিনি কহিলেন, “রমেশের ব্যাপার শুনিয়া আমি কিন্তু আশ্চর্য হইয়া গেছি–লোকে তাহার সম্বন্ধে অনেক কথা বলিয়াছে, আমি আজ পর্যন্ত তাহা বিশ্বাস করি নাই, কিন্তু আর তো–”

হেমনলিনী কাতরকণ্ঠে কহিল, “বাবা, ও-সকল কথার আলোচনা থাক্‌।”

অন্নদাবাবু কহিলেন, “মা, আলোচনা করিতে তো ইচ্ছা করেই না। কিন্তু বিধির বিপাকে অকস্মাৎ এক-একজন লোকের সঙ্গে আমাদের সুখদুঃখ জড়িত হইয়া যায়, তখন তাহার কোনো আচরণকে আর উপেক্ষা করিবার জো থাকে না।”

হেমনলিনী সবেগে বলিয়া উঠিল, “না না, সুখদুঃখের গ্রন্থি অমন করিয়া যেখানে সেখানে কেন জড়িত হইতে দিব। বাবা, আমি বেশ আছি, আমার জন্য বৃথা উদ্‌বিগ্ন হইয়া আমাকে লজ্জা দিয়ো না।”

অন্নদাবাবু কহিলেন, “মা হেম, আমার বয়স হইয়াছে, এখন তোমার একটা স্থিতি না করিয়া তো আমার মন স্থির হইতে পারে না। তোমাকে এমন তপস্বিনীর মতো কি আমি রাখিয়া যাইতে পারি?”

হেমনলিনী চুপ করিয়া রহিল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “দেখো মা, পৃথিবীতে একটা আশা চূর্ণ হইল বলিয়াই যে আর-সমস্ত দুর্মূল্য জিনিসকে অগ্রাহ্য করিতে হইবে, এমন কোনো কথা নাই। তোমার জীবন কিসে সুখী হইবে, সার্থক হইবে, আজ হয়তো মনের ক্ষোভে তাহা তুমি না জানিতেও পার, কিন্তু আমি নিয়ত তোমার মঙ্গলচিন্তা করি–আমি জানি তোমার কিসে সুখ, কিসে মঙ্গল–আমার প্রস্তাবটাকে একেবারে উপেক্ষা করিয়ো না।”

হেমনলিনী দুই চোখ ছল্‌ছল্‌ করিয়া বলিয়া উঠিল, “অমন কথা বলিয়ো না, আমি তোমার কোনো কথাই উপেক্ষা করি না। তুমি যাহা আদেশ করিবে আমি নিশ্চয় তাহা পালন করিব, কেবল একবার অন্তঃকরণটা পরিষ্কার করিয়া একবার ভালোরকম করিয়া প্রস্তুত হইয়া লইতে চাই।”

অন্নদাবাবু সেই অন্ধকারে একবার হেমনলিনীর অশ্রুসিক্ত মুখে হাত বুলাইয়া তাহার মস্তক স্পর্শ করিলেন। আর কোনো কথা কহিলেন না।

পরদিন সকালে যখন অন্নদাবাবু হেমনলিনীকে লইয়া বাহিরে গাছের তলায় চা খাইতে বসিয়াছেন, তখন অক্ষয় আসিয়া উপস্থিত হইল। অন্নদাবাবু নীরব প্রশ্নের সহিত তাহার মুখের দিকে চাহিলেন। অক্ষয় কহিল, “এখনো কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না।” এই বলিয়া এক পেয়ালা চা লইয়া সে সেখানে বসিয়া গেল।

আস্তে আস্তে কথা তুলিল, “রমেশবাবু ও কমলার জিনিসপত্র কিছু-কিছু চক্রবর্তী মহাশয়ের ওখানে রহিয়া গেছে, সেগুলি তিনি কোথায় কাহার কাছে পাঠাবেন, তাই ভাবিতেছেন। রমেশবাবু নিশ্চয়ই আপনাদের ঠিকানা বাহির করিয়া শীঘ্রই এখানে আসিবেন, তাই আপনাদের এখানে যদি–”

অন্নদাবাবু হঠাৎ অত্যন্ত রাগ করিয়া উঠিয়া কহিলেন, “অক্ষয়, তোমার কাণ্ডজ্ঞান কিছুমাত্র নাই। রমেশ আমার এখানেই বা কেন আসিবে, আর তাহার জিনিসপত্র আমিই বা কেন রাখিতে যাইব?”

অক্ষয় কহিল, “যা হোক, অন্যায় করুন আর ভুল করুন রমেশবাবু এখন নিশ্চয়ই অনুতপ্ত হইয়াছেন, এ সময়ে কি তাঁহাকে সান্ত্বনা দেওয়া তাঁহার পুরাতন বন্ধুদের কর্তব্য নয়? তাঁহাকে কি একেবারেই পরিত্যাগ করিতে হইবে?”

অন্নদাবাবু কহিলেন, “অক্ষয়, তুমি কেবল আমাদের পীড়ন করিবার জন্য এই কথাটা লইয়া বার বার আন্দোলন করিতেছ। আমি তোমাকে বিশেষ করিয়া বলিয়া দিতেছি, এ প্রসঙ্গ তুমি আমাদের কাছে কখনোই তুলিয়ো না।”

হেমনলিনী স্নিগ্ধস্বরে বলিল, “বাবা, তুমি রাগ করিয়ো না, তোমার অসুখ করিবে–অক্ষয়বাবু যাহা বলিতে চান বলুন-না, তাহাতে দোষ কী।”

অক্ষয় কহিল, “না না, আমাকে মাপ করিবেন, আমি ঠিক বুঝিতে পারি নাই।”

৫৪

মুকুন্দবাবু সপরিজনে কাশী ত্যাগ করিয়া মিরাটে যাইবেন, স্থির হইয়া গেছে। জিনিসপত্র বাঁধা হইয়াছে, কাল প্রভাতেই ছাড়িতেই হইবে। কমলা নিতান্ত আশা করিয়াছিল, ইতিমধ্যে এমন একটা-কিছু ঘটনা ঘটিবে যাহাতে তাহাদের যাওয়া বন্ধ হইবে। ইহাও সে একান্তমনে আশা করিয়াছিল যে, নলিনাক্ষ ডাক্তার হয়তো, আর দুই-একবার তাঁহার রোগীকে দেখিতে আসিবেন। কিন্তু দুইয়ের কোনোটাই ঘটিল না।

পাছে বামুন-ঠাকরুন যাত্রার উদ্‌যোগের গোলেমালে পালাইয়া যাইবার অবকাশ পায়, এই আশঙ্কায় নবীনকালী তাহাকে কয়দিন সর্বদাই কাছে কাছে রাখিয়াছেন, তাহাকে দিয়াই জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদার অনেক কাজ করাইয়া লইয়াছেন।

কমলা একান্তমনে কামনা করিতে লাগিল, আজ রাত্রির মধ্যে তাহার এমন একটা কঠিন পীড়া হয় যে, তাহাকে সঙ্গে লইয়া যাওয়া নবীনকালীর পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠে। সেই গুরুতর পীড়ার চিকিৎসাভার কোন্‌ ডাক্তারের উপর পড়িবে তাহাও সে মনে মনে ভাবে নাই এমন নহে। এই পীড়ায় যদি অবশেষে তাহার মৃত্যু ঘটে, তবে আসন্ন মৃত্যুকালে সেই চিকিৎসকের পায়ের ধুলা লইয়া সে মরিতে পারিবে, ইহাও সে চোখ বুজিয়া কল্পনা করিতেছিল।

রাত্রে নবীনকালী কমলাকে আপনার ঘরে লইয়া শুইলেন। পরদিন স্টেশনে যাইবার সময় নিজের গাড়ির মধ্যে তুলিয়া লইলেন। কর্তা মুকুন্দবাবু রেলগাড়িতে সেকেণ্ড্‌ ক্লাসে উঠিলেন, নবীনকালী বামুন-ঠাকরুনকে লইয়া ইণ্টার্‌মিডিয়েটে স্ত্রীকক্ষে আশ্রয়লাভ করিলেন।

0 Shares