নৌকা ডুবি

একদিন সকালে রমেশ তাহার পড়িবার ঘরে আসিয়া দেখে, টেবিলের উপর রেশমের ফুলকাটা মখমলে বাঁধানো একটি ব্লটিং-বহি সাজানো রহিয়াছে। তাহার একটি কোণে “র’ অক্ষর লেখা আছে, আর-এক কোণে সোনালি জরি দিয়া একটি পদ্ম আঁকা। বইখানির ইতিহাস ও তাৎপর্য বুঝিতে রমেশের ক্ষণমাত্রও বিলম্ব হইল না। তাহার বুক নাচিয়া উঠিল। সেলাই জিনিসটা তুচ্ছ নহে, তাহা তাহার অন্তরাত্মা বিনা তর্কে, বিনা প্রতিবাদে স্বীকার করিয়া লইল। ব্লটিং-বইটা বুকে চাপিয়া ধরিয়া সে অক্ষয়ের কাছেও হার মানিতে রাজি হইল। সেই ব্লটিং-বই খুলিয়া তখনি তাহার উপরে একখানি চিঠির কাগজ রাখিয়া সে লিখিল–

“আমি যদি কবি হইতাম, তবে কবিতা লিখিয়া প্রতিদান দিতাম, কিন্তু প্রতিভা হইতে আমি বঞ্চিত। ঈশ্বর আমাকে দিবার ক্ষমতা দেন নাই, কিন্তু লইবার ক্ষমতাও একটা ক্ষমতা। আশাতীত উপহার আমি যে কেমন করিয়া গ্রহণ করিলাম, অন্তর্যামী ছাড়া তাহা আর কেহ জানিতে পারিবে না। দান চোখে দেখা যায়, কিন্তু আদান হৃদয়ের ভিতরে লুকানো। ইতি। চিরঋণী।”

এই লিখনটুকু হেমনলিনীর হাতে পড়িল। তাহার পরে এ সম্বন্ধে উভয়ের মধ্যে আর-কোনো কথাই হইল না।

বর্ষাকাল ঘনাইয়া আসিল। বর্ষাঋতুটা মোটের উপরে শহুরে মনুষ্যসমাজের পক্ষে তেমন সুখকর নহে– ওটা আরণ্যপ্রকৃতিরই বিশেষ উপযোগী; শহরের বাড়িগুলা তাহার রুদ্ধ বাতায়ন ও ছাদ লইয়া, পথিক তাহার ছাতা লইয়া, ট্রামগাড়ি তাহার পর্দা লইয়া বর্ষাকে কেবল নিষেধ করিবার চেষ্টায় ক্লেদাক্ত পঙ্কিল হইয়া উঠিতেছে। নদী-পর্বত-অরণ্য-প্রান্তর বর্ষাকে সাদর কলরবে বন্ধু বলিয়া আহ্বান করে। সেইখানেই বর্ষার যথার্থ সমারোহ– সেখানে শ্রাবণে দ্যুলোক-ভূলোকের আনন্দসম্মিলনের মাঝখানে কোনো বিরোধ নাই।

কিন্তু নূতন ভালোবাসায় মানুষকে অরণ্যপর্বতের সঙ্গেই একশ্রেণীভুক্ত করিয়া দেয়। অবিশ্রাম বর্ষায় অন্নদাবাবুর পাকযন্ত্র দ্বিগুণ বিকল হইয়া গেল, কিন্তু রমেশ-হেমনলিনীর চিত্তস্ফূর্তির কোনো ব্যতিক্রম দেখা গেল না। মেঘের ছায়া, বজ্রের গর্জন, বর্ষণের কলশব্দ তাহাদের দুই জনের মনকে যেন ঘনিষ্ঠতর করিয়া তুলিল। বৃষ্টির উপলক্ষে রমেশের আদালতযাত্রার প্রায়ই বিঘ্ন ঘটিতে লাগিল। এক-এক দিন সকালে এমনি চাপিয়া বৃষ্টি আসে যে, হেমনলিনী উদ্‌বিগ্ন হইয়া বলে, “রমেশবাবু, এ বৃষ্টিতে আপনি বাড়ি যাইবেন কী করিয়া?” রমেশ নিতান্ত লজ্জার খাতিরে বলে, “এইটুকু বৈ তো নয়, কোনোরকম করিয়া যাইতে পারিব।” হেমনলিনী বলে, “কেন ভিজিয়া সর্দি করিবেন? এইখানেই খাইয়া যান-না।” সর্দির জন্য উৎকণ্ঠা রমেশের কিছুমাত্র ছিল না, অল্পেই যে তাহার সর্দি হয়, এমন কোনো লক্ষণও তাহার আত্মীয়বন্ধুরা দেখে নাই; কিন্তু বর্ষণের দিনে হেমনলিনীর শুশ্রূষাধীনেই তাহাকে কাটাইতে হইত– দুই পা মাত্র চলিয়াও বাসায় যাওয়া অন্যায় দুঃসাহসিকতা বলিয়া গণ্য হইত। কোনোদিন বাদলার একটু বিশেষ লক্ষণ দেখা দিলেই হেমনলিনীদের ঘরে প্রাতঃকালে রমেশের খিচুড়ি এবং অপরাহ্নে ভাজাভুজি খাইবার নিমন্ত্রণ জুটিত। বেশ দেখা গেল, হঠাৎ সর্দি লাগিবার সম্বন্ধে ইহাদের আশঙ্কা যত অতিরিক্ত প্রবল ছিল, পরিপাকের বিভ্রাট সম্বন্ধে ততটা ছিল না।

এমনি দিন কাটিতে লাগিল। এই আত্মবিস্মৃত হৃদয়াবেগের পরিণাম কোথায়, রমেশ স্পষ্ট করিয়া ভাবে নাই। কিন্তু অন্নদাবাবু ভাবিতেছিলেন, এবং তাঁহাদের সমাজের আরো পাঁচ জন আলোচনা করিতেছিল। একে রমেশের পাণ্ডিত্য যতটা কাণ্ডজ্ঞান ততটা নাই, তাহাতে তাহার বর্তমান মুগ্ধ অবস্থায় তাহার সাংসারিক বুদ্ধি আরো অস্পষ্ট হইয়া গেছে। অন্নদাবাবু প্রত্যহই বিশেষ প্রত্যাশার সহিত তাহার মুখের দিকে চান, কিন্তু কোনো জবাবই পান না।

১০

অক্ষয়ের গলা বিশেষ ভালো ছিল না, কিন্তু সে যখন নিজে বেহালা বাজাইয়া গান গাহিত তখন অত্যন্ত কড়া সমজদার ছাড়া সাধারণ শ্রোতার দল আপত্তি করিত না, এমন-কি, আরো গাহিতে অনুরোধ করিত। অন্নদাবাবুর সংগীতে বিশেষ অনুরক্তি ছিল না, কিন্তু সে কথা তিনি কবুল করিতে পারিতেন না– তবু তিনি আত্মরক্ষার কথঞ্চিৎ চেষ্টা করিতেন। কেহ অক্ষয়কে গান গাহিতে অনুরোধ করিলে তিনি বলিতেন, “ঐ তোমাদের দোষ, বেচারা গাহিতে পারে বলিয়াই কি উহার ‘পরে অত্যাচার করিতে হইবে?”

অক্ষয় বিনয় করিয়া বলিত, “না না অন্নদাবাবু, সেজন্য ভাবিবেন না– অত্যাচারটা কাহার ‘পরে হইবে সেইটেই বিচার্য।”

অনুরোধের তরফ হইতে জবাব আসিত, “তবে পরীক্ষা হউক।”

সেদিন অপরাহ্নে খুব ঘনঘোর করিয়া মেঘ আসিয়াছিল। প্রায় সন্ধ্যা হইয়া আসিল, তবু বৃষ্টির বিরাম নাই। অক্ষয় আবদ্ধ হইয়া পড়িল। হেমনলিনী কহিল, “অক্ষয়বাবু, একটা গান করুন।”

এই বলিয়া হেমনলিনী হারমোনিয়মে সুর দিল।

অক্ষয় বেহালা মিলাইয়া লইয়া হিন্দুস্থানি গান ধরিল–

বায়ু বহীঁ পুরবৈঞা, নীদ নহিঁ বিন সৈঞা।

গানের সকল কথার স্পষ্ট অর্থ বুঝা যায় না– কিন্তু একেবারে প্রত্যেক কথায় কথায় বুঝিবার কোনো প্রয়োজন নাই। মনের মধ্যে যখন বিরহমিলনের বেদনা সঞ্চিত হইয়া আছে, তখন একটু আভাসই যথেষ্ট। এটুকু বোঝা গেল যে, বাদল ঝরিতেছে, ময়ূর ডাকিতেছে এবং একজনের জন্য আর-একজনের ব্যাকুলতার অন্ত নাই।

0 Shares