নৌকা ডুবি

কমলা শৈলকে কহিল, “দিদি, তুমিও চলো-না।”

শৈল কহিল, “না ভাই, উমির শরীর তেমন ভালো নাই।”

খুড়া যে পথ দিয়া স্নানের ঘাটে গেলেন স্নানান্তে সে পথ দিয়া না ফিরিয়া অন্য এক রাস্তায় চলিলেন। কিছু দূর গিয়াই দেখিলেন, একটি প্রবীণা স্নান সারিয়া পট্টবস্ত্র পরিয়া ঘটিতে গঙ্গাজল লইয়া ধীরে ধীরে আসিতেছেন।

কমলাকে সম্মুখে আনিয়া খুড়া কহিলেন, “মা, ইঁহাকে প্রণাম করো, ইনি ডাক্তারবাবুর মাতা।”

কমলা শুনিয়া চকিত হইয়া উঠিয়া, তৎক্ষণাৎ ক্ষেমংকরীকে প্রণাম করিয়া তাঁহার পায়ের ধুলা লইল।

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “তুমি কে গা! দেখি দেখি, কী রূপ! যেন লক্ষ্মীটির প্রতিমা!”

বলিয়া কমলার ঘোমটা সরাইয়া তাহার নতনেত্র মুখখানি ভালো করিয়া দেখিলেন। কহিলেন, “তোমার নাম কী বাছা?”

কমলা উত্তর করিবার পূর্বেই খুড়া কহিলেন, “ইঁহার নাম হরিদাসী। ইনি আমার দূরসম্পর্কের ভ্রাতুষ্পুত্রী। ইহার মা-বাপ কেহ নাই, আমার উপরেই নির্ভর।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আসুন-না চক্রবর্তীমশায়, আমার বাড়িতেই আসুন।”

বাড়িতে লইয়া গিয়া ক্ষেমংকরী একবার নলিনাক্ষকে ডাকিলেন। নলিনাক্ষ তখন বাহির হইয়া গেছেন।

খুড়া আসন গ্রহণ করিলেন, কমলা মেজের উপরে বসিল। খুড়া কহিলেন, “দেখুন, আমার এই ভাইঝির ভাগ্য বড়ো মন্দ। বিবাহের পরদিনই ইহার স্বামী সন্ন্যাসী হইয়া বাহির হইয়া গেছেন, ইঁহার সঙ্গে আর দেখা-সাক্ষাৎ নাই। হরিদাসীর ইচ্ছা ধর্মকর্ম লইয়া তীর্থবাস করে–ধর্ম ছাড়া উঁহার সান্ত্বনার সামগ্রী আর তো কিছুই নাই। এখানে আমার বাড়ি নয়, আমার চাকরি আছে–উপার্জন করিয়া আমাকে সংসার চালাইতে হয়। আমি যে এখানে আসিয়া ইঁহাকে লইয়া থাকিব, আমার এমন সুবিধা নাই। তাই আপনার শরণাপন্ন হইয়াছি। এটিকে আপনার মেয়ের মতো যদি কাছে রাখেন তবে আমি বড়ো নিশ্চিন্ত হই। যখনই অসুবিধা বোধ করিবেন গাজিপুরে আমার কাছে পাঠাইয়া দিবেন। কিন্তু আমি বলিতেছি দুদিন ইঁহাকে কাছে রাখিলেই মেয়েটি কী রত্ন তাহা বুঝিতে পারিবেন, তখন মুহূর্তের জন্য ছাড়িতে চাহিবেন না।”

ক্ষেমংকরী খুশি হইয়া কহিলেন, “আহা, এ তো ভালো কথা। এমন মেয়েটিকে আপনি যে আমার কাছে রাখিয়া যাইতেছেন, এ তো আমার মস্ত লাভ। আমি কতদিন রাস্তা হইতে পরের মেয়েকে বাড়িতে আনিয়া খাওয়াইয়া পরাইয়া আনন্দ করি, কিন্তু তাহাদের তো রাখিতে পারি না। তা, হরিদাসী আমারই হইল, আপনি ইহার জন্য কিছুমাত্র ভাবিবেন না। আমার ছেলের কথা অবশ্য আপনারা পাঁচজনের কাছে শুনিয়া থাকিবেন–নলিনাক্ষ–সে বড়ো ভালো ছেলে। সে ছাড়া বাড়িতে আর কেহ নাই।”

খুড়া কহিলেন, “নলিনাক্ষবাবুর নাম সকলেই জানে। তিনি এখানে আপনার কাছে থাকেন জানিয়া আমি আরো নিশ্চিন্ত। আমি শুনিয়াছি, বিবাহের পর দুর্ঘটনায় তাঁহার স্ত্রী জলে ডুবিয়া মারা যাওয়াতে তিনি সেই অবধি একরকম ব্রহ্মচারীর মতোই আছেন।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সে যাহা হইয়াছে হইয়াছে, ও কথা আর তুলিবেন না–মনে করিলেও আমার গায়ে কাঁটা দিয়া ওঠে।”

খুড়া কহিলেন, “যদি অনুমতি করেন তবে মেয়েটিকে আপনার কাছে রাখিয়া এখন বিদায় হই। মাঝে মাঝে আসিয়া দেখিয়া যাইব। ইঁহার একটি বড়ো বোন আছে, সেও আপনাকে প্রণাম করিতে আসিবে।”

খুড়া চলিয়া গেলে ক্ষেমংকরী কমলাকে কাছে টানিয়া লইয়া কহিলেন, “এসো তো মা, দেখি। তোমার বয়স তো বেশি নয়। আহা, তোমাকে ফেলিয়া যাইতে পারে, জগতে এমন পাষাণও আছে! আমি আশীর্বাদ করিতেছি, সে আবার ফিরিয়া আসিবে। বিধাতা এত রূপ কখনো বৃথা নষ্ট করিবার জন্য গড়েন নাই।”

বলিয়া কমলার চিবুক স্পর্শ করিয়া অঙ্গুলির দ্বারা চুম্বন গ্রহণ করিলেন।

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “এখানে তোমার সমবয়সী সঙ্গিনী কেহ নাই, একলা আমার কাছে থাকিতে পারিবে তো?”

কমলা তাহার দুই বড়ো বড়ো স্নিগ্ধ চক্ষে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করিয়া কহিল, “পারিব মা!”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “তোমার দিন কাটিবে কী করিয়া আমি তাই ভাবিতেছি।”

কমলা কহিল, “আমি তোমার কাজ করিব।”

ক্ষেমংকরী। পোড়াকপাল! আমার আবার কাজ! সংসারে ঐ তো আমার একটিমাত্র ছেলে, সেও সন্ন্যাসীর মতো থাকে–কখনো যদি বলিত “মা, এইটে আমার দরকার আছে, আমি এইটে খেতে চাই, আমি এইটে ভালোবাসি’,তবে আমি কত খুশি হইতাম–তাও কখনো বলে না। রোজগার ঢের করে, হাতে কিছুই রাখে না ; কত সৎকাজে যে কত দিকে খরচ করে তাহা কাহাকে জানিতেও দেয় না। দেখো বাছা, আমার কাছে যখন তোমাকে চব্বিশ ঘন্টা থাকিতে হইবে তখন এ কথা আগে হইতেই বলিয়া রাখিতেছি, আমার মুখে আমার ছেলের গুণগান বার বার শুনিয়া তোমার বিরক্ত ধরিবে, কিন্তু ঐটে তোমাকে সহ্য করিয়া যাইতে হইবে।

কমলা পুলকিতচিত্তে চক্ষু নত করিল।

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আমি তোমাকে কী কাজ দিব, তাই ভাবিতেছি। সেলাই করিতে জান।”

কমলা কহিল, “ভালো জানি না মা!”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আচ্ছা, আমি তোমাকে সেলাই শিখাইয়া দিব।”

ক্ষেমংকরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “পড়িতে জান তো?”

কমলা কহিল, “হাঁ, জানি।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সে হইল ভালো। চোখে তো আর চশমা নহিলে দেখিতে পাই না, তুমি আমাকে পড়িয়া শোনাইতে পারিবে।”

কমলা কহিল, “আমি রাঁধাবাড়া ঘরকন্নার কাজ সমস্ত শিখিয়াছি।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “অমন অন্নপূর্ণার মতো চেহারা, তুমি যদি রাঁধাবাড়ার কাজ না জানিবে তো কে জানিবে। আজ পর্যন্ত নলিনকে আমি নিজে রাঁধিয়া খাওয়াইয়াছি–আমার অসুখ হইলে বরঞ্চ স্বপাক রাঁধিয়া খায়, তবু আর কাহারো হাতে খায় না। এবার হইতে তোমার কল্যাণে তাহার স্বপাক খাওয়া আমি ঘোচাইব। আর, অক্ষম হইয়া পড়িলে আমাকেও যদি চারটিখানি হবিষ্যান্ন রাঁধিয়া খাওয়াও তো আমার তাহাতে অনভিরুচি হইবে না। চলো মা, তোমাকে আমার ভাঁড়ার-ঘর রান্নাঘর সমস্ত দেখাইয়া আনি।”

0 Shares