প্রজাপতির নির্বন্ধ

বিপিন হাসিয়া কহিল, “সে ঢের সময় আছে, যা কালই শুরু করা যেতে পারে এমন একটা কিছু কাজ বলো। “মারি তো গণ্ডার লুঠি তো ভাণ্ডার’ যদি পণ করে বস তবে গণ্ডারও বাঁচবে ভাণ্ডারও বাঁচবে, তুমিও যেমন আরামে আছ তেমনি আরামে থাকবে। আমি প্রস্তাব করি আমরা প্রত্যেকে দুটি করে বিদেশী ছাত্র পালন করব, তাদের পড়াশুনো এবং শরীর-মনের সমস্ত চর্চার ভার আমাদের উপর থাকবে।”

শ্রীশ কহিল, “এই তোমার কাজ! এর জন্যই আমরা সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করেছি! শেষকালে ছেলে মানুষ করতে হবে, তা হলে নিজের ছেলে কী অপরাধ করেছে!”

বিপিন বিরক্ত হইয়া কহিল, “তা যদি বল তা হলে সন্ন্যাসীর তো কর্মই নেই; কর্মের মধ্যে ভিক্ষে আর ভ্রমণ আর ভণ্ডামি।”

শ্রীশ রাগিয়া কহিল, “আমি দেখছি আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন এ সভার মহৎ উদ্দেশ্যের প্রতি যাঁদের শ্রদ্ধামাত্র নেই, তাঁরা যত শীঘ্র এ সভা পরিত্যাগ করে সন্তানপালনে প্রবৃত্ত হন ততই আমাদের মঙ্গল!”

বিপিন আরক্তবর্ণ হইয়া বলিল, “নিজের সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই নে কিন্তু এ সভায় এমন কেউ কেউ আছেন যাঁরা সন্ন্যাসগ্রহণের কঠোরতা এবং সন্তানপালনের ত্যাগস্বীকার দুয়েরই অযোগ্য, তাঁদের–”

চন্দ্রমাধববাবু চোখের কাছ হইতে কার্যবিবরণের খাতা নামাইয়া কহিলেন, “উত্থাপিত প্রস্তাব সম্বন্ধে পূর্ণবাবুর অভিপ্রায় জানতে পারলে আমার মন্তব্য প্রকাশ করবার অবসর পাই।”

পূর্ণ কহিল, “অদ্য বিশেষরূপে সভার ঐক্যবিধানের জন্য একটা কাজ অবলম্বন করবার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু কাজের প্রস্তাবে ঐক্যের লক্ষণ কিরকম পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে সে আর কাউকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার দরকার নেই। ইতিমধ্যে আমি যদি আবার একটা তৃতীয় মত প্রকাশ করে বসি তা হলে বিরোধানলে তৃতীয় আহুতি দান করা হবে– অতএব আমার প্রস্তাব এই যে, সভাপতিমশায় আমাদের কাজ নির্দেশ করে দেবেন এবং আমরা তাই শিরোধার্য করে নিয়ে বিনা বিচারে পালন করে যাব। কার্যসাধন এবং ঐক্যসাধনের এই একমাত্র উপায় আছে।”

পাশের ঘরে এক ব্যক্তি আবার একবার নড়িয়া চড়িয়া বসিল এবং তাহার চাবি ঝন্‌ করিয়া উঠিল!

বিষয়কর্মে চন্দ্রমাধববাবুর মতো অপটু কেহ নাই কিন্তু তাঁহার মনের খেয়াল বাণিজ্যের দিকে। তিনি বলিলেন, “আমাদের প্রথম কর্তব্য ভারতবর্ষের দারিদ্র৻মোচন এবং তার আশু উপায় বাণিজ্য। আমরা কয়জনে বড়ো বাণিজ্য চালাতে পারি নে, কিন্তু তার সূত্রপাত করতে পারি। মনে করো আমরা সকলেই যদি দিয়াশলাই সম্বন্ধে পরীক্ষা আরম্ভ করি। এমন যদি একটা কাঠি বের করতে পারি যা সহজে জ্বলে, শীঘ্র নেবে না এবং দেশের সর্বত্র প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, তা হলে দেশে সস্তা দেশলাই নির্মাণের কোনো বাধা থাকে না।” এই বলিয়া জাপানে এবং য়ুরোপে সবসুদ্ধ কত দেশলাই প্রস্তুত হয়, তাহাতে কোন্‌ কোন্‌ কাঠের কাঠি ব্যবহার হয়, কাঠির সঙ্গে কী কী দাহ্য পদার্থ মিশ্রিত করে, কোথা হইতে কত দেশালাই রপ্তানি হয়, তাহার মধ্যে কত ভারতবর্ষে আসে এবং তাহার মূল্য কত চন্দ্রমাধববাবু তাহা বিস্তারিত করিয়া বলিলেন।

বিপিন শ্রীশ নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। পূর্ণ কহিল, “পাকাটি এবং খ্যাংরা কাঠি দিয়ে শীঘ্রই পরীক্ষা করে দেখব।”

শ্রীশ মুখ ফিরাইয়া হাসিল।

এমন সময় ঘরের মধ্যে অক্ষয় আসিয়া প্রবেশ করিলেন। কহিলেন, “মশায়, প্রবেশ করতে পারি?”

ক্ষীণদৃষ্টি চন্দ্রমাধববাবু হঠাৎ চিনিতে না পারিয়া ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন। অক্ষয় কহিলেন, “মশায়, ভয় পাবেন না এবং অমন ভ্রূকুটি করে আমাকেও ভয় দেখাবেন না– আমি অভূতপূর্ব নই– এমন-কি, আমি আপনাদেরই ভূতপূর্ব– আমার নাম–”

চন্দ্রমাধববাবু তাড়াতাড়ি উঠিয়া কহিলেন, “আর নাম বলতে হবে না– আসুন আসুন অক্ষয়বাবু–”

তিন তরুণ সভ্য অক্ষয়কে নমস্কার করিল। বিপিন ও শ্রীশ দুই বন্ধু সদ্যোবিবাদের বিমর্ষতায় গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিল। পূর্ণ কহিল, “মশায়, অভূতপূর্বর চেয়ে ভূতপূর্বকেই বেশি ভয় হয়।”

অক্ষয় কহিলেন, “পূর্ণবাবু বুদ্ধিমানের মতো কথাই বলেছেন। সংসারে ভূতের ভয়টাই প্রচলিত। নিজে যে ব্যক্তি ভূত অন্যলোকের জীবনসম্ভোগটা তার কাছে বাঞ্ছনীয় হতে পারেই না, এই মনে করে মানুষ ভূতকে ভয়ংকর কল্পনা করে। অতএব সভাপতিমশায়, চিরকুমার-সভার ভূতটিকে সভা থেকে ঝাড়াবেন না পূর্ব-সম্পর্কের মমতাবশত একখানা চৌকি দেবেন, এইবেলা বলুন।”

“চৌকি দেওয়াই স্থির” বলিয়া চন্দ্রবাবু একখানি চেয়ার অগ্রসর করিয়া দিলেন।

“সর্বসম্মতিক্রমে আসন গ্রহণ করলুম” বলিয়া অক্ষয়বাবু বসিলেন; বলিলেন, “আপনারা আমাকে নিতান্ত ভদ্রতা করে বসতে বললেন বলেই যে আমি অভদ্রতা করে বসেই থাকব আমাকে এমন অসভ্য মনে করবেন না– বিশেষত পান তামাক এবং পত্নী আপনাদের সভার নিয়মবিরুদ্ধ, অথচ ঐ তিনটে বদ অভ্যাসই আমাকে একেবারে মাটি করেছে, সুতরাং চট্‌পট্‌ কাজের কথা সেরেই বাড়িমুখো হতে হবে।”

চন্দ্রবাবু হাসিয়া কহিলেন, “আপনি যখন সভ্য নন তখন আপনার সম্বন্ধে সভার নিয়ম না-ই খাটালেম– পান-তামাকের বন্দোবস্ত বোধ হয় করে দিতে পারব, কিন্তু আপনার তৃতীয় নেশাই–”

অক্ষয়। সেটি এখানে বহন করে আনবার চেষ্টা করবেন না, আমার সে নেশাটি প্রকাশ্য নয়!

0 Shares