প্রজাপতির নির্বন্ধ

অক্ষয়। তা হবে না।

গান। কাফি

কার হাতে যে ধরা দেব প্রাণ;

তাই ভাবতে বেলা অবসান।

ডান দিকেতে তাকাই যখন, বাঁয়ের লাগি কাঁদে রে মন

বাঁয়ের লাগি ফিরলে তখন দক্ষিণেতে পড়ে টান।

আচ্ছা, আমার যেন সান্ত্বনার গুটি দুই-তিন সদুপায় আছে, কিন্তু তুমি

বিরহ-যামিনী কেমনে যাপিবে,

বিচ্ছেদতাপে যখন তাপিবে

এপাশ ওপাশ বিছানা মাপিবে,

মকরকেতনে কেবলি শাপিবে–

পুরবালা। রক্ষে করো, ও মিলটা ঐখানেই শেষ করো।

অক্ষয়। দুঃখের সময় আমি থামতে পারি নে– কাব্য আপনি বেরোতে থাকে। মিল ভালো না বাস অমিত্রাক্ষর আছে, তুমি যখন বিদেশে থাকবে আমি “আর্তনাদবধ কাব্য’ বলে একটা কাব্য লিখব– সখী, তার আরম্ভটা শোনো–

(সাড়ম্বরে)বাষ্পীয় শকটে চড়ি নারীচূড়ামণি

পুরবালা চলি যবে গেলা কাশীধামে

বিকালে, কহ হে দেবী অমৃতভাষিণী

কোন্‌ বরাঙ্গনে বরি বরমাল্যদানে

যাপিলা বিচ্ছেদমাস শ্যালীত্রয়ীশালী

শ্রীঅক্ষয়!

পুরবালা। (সগর্বে) আমার মাথা খাও, ঠাট্টা নয়, তুমি একটা সত্যিকার কাব্য লেখো-না।

অক্ষয়। মাথা খাওয়ার কথাটা যদি বললে, আমি নিজের মাথাটি খেয়ে অবধি বুঝেছি ওটা সুখাদ্যের মধ্যে গণ্য নয়। আর ঐ কাব্য লেখা, ও কার্যটাও সুসাধ্য বলে জ্ঞান করি নে। বুদ্ধিতে আমার এক জায়গায় ফুটো আছে, কাব্য জমতে পারে না– ফস ফস করে বেরিয়ে পড়ে।

তুমি জান আমার গাছে ফল কেন না ফলে!

যেমনি ফুলটি ফুটে ওঠে আনি চরণতলে।

কিন্তু আমার প্রশ্নের তো কোনো উত্তর পেলুম না। কৌতূহলে মরে যাচ্ছি। কাশীতে যে চলেছ, উৎসাহটা কিসের জন্যে? আপাতত সেই বিষ্ণুদূতটাকে মনে মনে ক্ষমা করলুম, কিন্তু ভগবান ভূতনাথ ভবানীপতির অনুচরগুলোর উপর ভারি সন্দেহ হচ্ছে। শুনেছি নন্দী ও ভৃঙ্গী অনেক বিষয়ে আমাকেও যেতে, ফিরে এসে হয়তো এই ভূতটিকে পছন্দ না হতেও পারে!

অক্ষয়ের পরিহাসের মধ্যে একটু যে অভিমানের জ্বালা ছিল, সেটুকু পুরবালা অনেকক্ষণ বুঝিয়াছে। তাহা ছাড়া, প্রথমে কাশী যাইবার প্রস্তাবে তাহার যে উৎসাহ হইয়াছিল, যাত্রার সময় যতই নিকটবর্তী হইতে লাগিল ততই তাহা ম্লান হইয়া আসিতেছে।

সে কহিল, “আমি কাশী যাব না।”

অক্ষয়। সে কী কথা! ভূতভাবনের যে ভৃত্যগুলি একবার মরে ভূত হয়েছে তারা যে দ্বিতীয় বার মরবে।

রসিকের প্রবেশ

পুরবালা। আজ যে রসিকদাদার মুখ ভারি প্রফুল্ল দেখাচ্ছে?

রসিক। ভাই, তোর রসিকদাদার মুখের ঐ রোগটা কিছুতেই ঘুচল না। কথা নেই বার্তা নেই প্রফুল্ল হয়েই আছে– বিবাহিত লোকেরা দেখে মনে মনে রাগ করে।

পুরবালা। শুনলে তো, বিবাহিত লোক! এর একটা উপযুক্ত জবাব দিয়ে যাও।

অক্ষয়। আমাদের প্রফুল্লতার খবর ও বৃদ্ধ কোথা থেকে জানবে? সে এত রহস্যময় যে, তা উদ্ভেদ করতে আজ পর্যন্ত কেউ পারলে না– সে এত গভীর যে আমরাই হাতড়ে খুঁজে পাই নে, হঠাৎ সন্দেহ হয় আছে কি না।

পুরবালা। “এই বুঝি!” বলিয়া রাগ করিয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিল।

অক্ষয় তাহাকে ধরিয়া ফিরাইয়া কহিল, “দোহাই তোমার, এই লোকটির সামনে রাগারাগি কোরো না– তা হলে ওর আস্পর্ধা আরো বেড়ে যাবে।– দেখো দাম্পত্য-তত্ত্বানভিজ্ঞ বৃদ্ধ, আমরা যখন রাগ করি তখন স্বভাবত আমাদের কণ্ঠস্বর প্রবল হয়ে ওঠে, সেইটেই তোমাদের কর্ণগোচর হয়; আর অনুরাগে যখন আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে, কানের কাছে মুখ আনতে গিয়ে মুখ বারম্বার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়তে থাকে, তখন তো খবর পাও না!”

পুরবালা। আঃ– চুপ করো।

অক্ষয়। যখন গয়নার ফর্দ হয় তখন বাড়ির সরকার থেকে সেকরা পর্যন্ত সেটা কারো অবিদিত থাকে না, কিন্তু বসন্তনিশীথে যখন প্রেয়সী–

পুরবালা। আঃ– থামো।

অক্ষয়। বসন্তনিশীথে প্রেয়সী–

পুরবালা। আঃ– কী বকছ তার ঠিক নেই!

অক্ষয়। বসন্তনিশীথে যখন প্রেয়সী গর্জন করে বলেন, “আমি কালই বাপের বাড়ি চলে যাব, আমার এক দণ্ড এখানে থাকতে ইচ্ছে নেই– আমার হাড় কালী হল– আমার–‘

পুরবালা। হাঁগো মশায়, কবে তোমার প্রেয়সী বাপের বাড়ি যাব বলে বসন্তনিশীথে গর্জন করেছে?

অক্ষয়। ইতিহাসের পরীক্ষা? কেবল ঘটনা রচনা করে নিষ্কৃতি নেই? আবার সন-তারিখ-সুদ্ধ মুখে মুখে বানিয়ে দিতে হবে? আমি কি এতবড়ো প্রতিভাশালী?

রসিক। (পুরবালার প্রতি) বুঝেছ ভাই, সোজা করে ও তোমার কথা বলতে পারে না– ওর এত ক্ষমতাই নেই– তাই উল্‌টে বলে; আদরে না কুলোলে গাল দিয়ে আদর করতে হয়।

পুরবালা। আচ্ছা মল্লিনাথজি, তোমার আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। মা যে শেষকালে তোমাকেই কাশী নিয়ে যাবেন স্থির করেছেন।

রসিক। তা, বেশ তো, এতে আর ভয়ের কথাটা কী? তীর্থে যাবার তো বয়সই হয়েছে। এখন তোমাদের লোলকটাক্ষে এ বৃদ্ধের কিছুই করতে পারবে না– এখন চিত্ত চন্দ্রচূড়ের চরণে–

মুগ্ধস্নিগ্ধবিদগ্ধমধুরৈর্লালৈঃ কটাক্ষৈরলং

চেতঃ সম্প্রতি চন্দ্রচূড়চরণধ্যানামৃতে বর্ততে।

পুরবালা। সে তো খুব ভালো কথা– তোমার উপরে আর কটাক্ষের অপব্যয় করতে চাই নে, এখন চন্দ্রচূড় চরণে চলো– তা হলে মাকে ডাকি!

রসিক। (করজোড়ে) বড়দিদি ভাই, তোমার মা আমাকে সংশোধনের বিস্তর চেষ্টা করছেন, কিন্তু একটু অসময়ে সংস্কারকার্য আরম্ভ করেছেন– এখন তাঁর শাসনে কোনো ফল হবে না। বরঞ্চ এখনো নষ্ট হবার বয়স আছে, সে বয়সটা বিধাতার কৃপায় বরাবরই থাকে, লোলকটাক্ষটা শেষকাল পর্যন্ত খাটে, কিন্তু উদ্ধারের বয়স আর নেই। তিনি এখন কাশী যাচ্ছেন, কিছুদিন এই বৃদ্ধ শিশুর বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতিসাধনের দুরাশা পরিত্যাগ করে শান্তিতে থাকুন– কেন তোরা তাঁকে কষ্ট দিবি।

0 Shares