প্রজাপতির নির্বন্ধ

পুরবালা এই-সকল নিয়মবিরুদ্ধ ব্যাপার মনে মনে পছন্দ করিত না। কিন্তু তাহার স্বামীর ও ভগিনীটির বিচিত্র কৌতুকলীলায় সর্বদা বাধা দিতেও তাহার মন সরিত না। নিজের স্বামিসৌভাগ্যের কথা স্মরণ করিয়া বিধবা বোনটির প্রতি তাহার করুণা ও প্রশ্রয়ের অন্ত ছিল না। ভাবিত, হতভাগিনী যেমন করিয়া ভুলিয়া থাকে থাক্‌। পুরবালা জিনিসপত্র গুছাইতে গেল।

এমন সময় নৃপবালা ও নীরবালা ঘরে প্রবেশ করিয়াই পলায়নোদ্যত হইল। নীর দরজার আড়াল হইতে আর-একবার ভালো করিয়া তাকাইয়া “মেজদিদি” বলিয়া ছুটিয়া আসিল। কহিল, “মেজদিদি, তোমাকে ভাই জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ঐ চাপকানে বাধছে। মনে হচ্ছে তুমি যেন কোন্‌ রূপকথার রাজপুত্র, তোপান্তর-মাঠ পেরিয়ে আমাদের উদ্ধার করতে এসেছ।”

নীরর সমুচ্চ কণ্ঠস্বরে আশ্বস্ত হইয়া নৃপও ঘরে প্রবেশ করিয়া মুগ্ধনেত্রে চাহিয়া রহিল। নীর তাহাকে টানিয়া লইয়া কহিল, “অমন করে লোভীর মতো তাকিয়ে আছিস কেন? যা মনে করছিস তা নয়, ও তোর দুষ্যন্ত নয়– ও আমাদের মেজদিদি।”

রসিক।

ইয়মধিকমনোজ্ঞা চাপ্‌ কানেনাপি তন্বী।

কিমিব হি মধুরাণাং মণ্ডনং নাকৃতীনাম॥

অক্ষয়। মুঢ়ে, তোরা কেবল চাপকানটা দেখেই মুগ্ধ! গিল্‌টির এত আদর? এ দিকে যে খাঁটি সোনা দাঁড়িয়ে হাহাকার করছে।

নীরবালা। আজকাল খাঁটি সোনার দর যে বড়ো বেশি, আমাদের এই গিল্‌টিই ভালো! কী বল ভাই মেজদিদি!– বলিয়া শৈলর কৃত্রিম গোঁফটা একটু পাকাইয়া দিল।

রসিক। (নিজেকে দেখাইয়া) এই খাঁটি সোনাটি খুব সস্তায় যাচ্ছে ভাই– এখনো কোনো ট্যাঁকশালে গিয়ে কোনো মহারানীর ছাপটি পর্যন্ত পড়ে নি!

নীরবালা। আচ্ছা বেশ, সেজদিদিকে দান করলুম। (বলিয়া রসিকদাদার হাত ধরিয়া নৃপর হাতে সমর্পণ করিল) রাজি আছিস তো ভাই?

নৃপবালা। তা আমি রাজি আছি।– বলিয়া রসিকদাদাকে একটা চৌকিতে বসাইয়া সে তাঁহার মাথার পাকা চুল তুলিয়া দিতে লাগিল।

নীর শৈলর কৃত্রিম গোঁফে তা দিয়া পাকাইয়া তুলিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। শৈল কহিল, “আঃ, কী করছিস, আমার গোঁফ পড়ে যাবে।”

রসিক। কাজ কী, এ দিকে আয় না ভাই, এ গোঁফ কিছুতেই পড়বে না।

নীরবালা। আবার! ফের! সেজদিদির হাতে সঁপে দিলুম কী করতে? আচ্ছা রসিকদাদা, তোমার মাথার দুটো-একটা চুল কাঁচা আছে, কিন্তু গোঁফ আগাগোড়া পাকালে কী করে?

রসিক। কারো কারো মাথা পাকবার আগে মুখটা পাকে।

নীরবালা। দিদিদের সভাটা কোন্‌ ঘরে বসবে মুখুজ্যেমশায়?

অক্ষয়। আমার বসবার ঘরে।

নীরবালা। তা হলে সে ঘরটা একটু সাজিয়ে গুজিয়ে দিইগে।

অক্ষয়। যতদিন আমি সে ঘরটা ব্যবহার করছি, একদিনও সাজাতে ইচ্ছে হয় নি বুঝি?

নীরবালা। তোমার জন্যে ঝড়ু বেহারা আছে, তবু বুঝি আশা মিটল না?

পুরবালার প্রবেশ

পুরবালা। কী হচ্ছে তোমাদের?

নীরবালা। মুখুজ্যেমশায়ের কাছে পড়া বলে নিতে এসেছি দিদি। তা উনি বলছেন, ওঁর বাইরের ঘরটা ভালো করে ঝেড়ে সাজিয়ে না দিলে উনি পড়াবেন না। তাই সেজদিদিতে আমাতে ওঁর ঘর সাজাতে যাচ্ছি। আয় ভাই।

নৃপবালা। তোর ইচ্ছে হয়েছে তুই ঘর সাজাতে যা-না– আমি যাব না।

নীরবালা। বাঃ, আমি একা খেটে মরব আর তুমি সুদ্ধ তার ফল পাবে, সে হবে না।

নৃপকে গ্রেফতার করিয়া লইয়া নীর চলিয়া গেল।

পুরবালা। সব গুছিয়ে নিয়েছি। এখনো ট্রেন যাবার দেরি আছে বোধ হয়।

অক্ষয়। যদি মিস করতে চাও তা হলে ঢের দেরি আছে।

পুরবালা। তা হলে চলো, আমাকে স্টেশনে পৌঁছে দেবে। চললুম রসিকদাদা– তুমি এখানে রইলে, এই শিশুগুলিকে একটু সামলে রেখো।

[প্রণাম

রসিক। কিছু ভেবো না দিদি, এরা সকলে আমাকে যেরকম বিপরীত ভয় করে, টুঁশব্দটি করতে পারবে না।

শৈল। দিদিভাই, তুমি একটু থামো। আমি এই কাপড়টা ছেড়ে এসে তোমাকে প্রণাম করছি।

পুরবালা। কেন? ছাড়তে মন গেল যে?

শৈল। না ভাই, এ কাপড়ে নিজেকে আর-একজন বলে মনে হয়, তোদের গায়ে হাত দিতে ইচ্ছে হয় না! রসিকদাদা, এই নাও, আমার গোঁফটা সাবধানে রেখে দাও, হারিয়ো না।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

শ্রীশ তাহার বাসায় দক্ষিণের বারান্দায় একখানা বড়োহাতাওআলা কেদারায় দুই হাতার উপর দুই পা তুলিয়া দিয়া শুক্লসন্ধ্যায় চুপচাপ বসিয়া সিগারেট ফুঁকিতেছিল। পাশে টিপায়ের উপর রেকাবিতে একটি গ্লাস বরফ-দেওয়া লেমনেড ও স্তূপাকার কুন্দফুলের মালা।

বিপিন পশ্চাৎ হইতে প্রবেশ করিয়া তাহার স্বাভাবিক প্রবল গম্ভীর কণ্ঠে ডাকিয়া উঠিল, “কী গো সন্ন্যাসীঠাকুর।”

শ্রীশ তৎক্ষণাৎ হাতা হইতে পা নামাইয়া উঠিয়া বসিয়া উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল। কহিল, “এখনো বুঝি ঝগড়া ভুলতে পারো নি?”

শ্রীশ কিছুক্ষণ আগেই ভাবিতেছিল, একবার বিপিনের ওখানে যাওয়া যাক। কিন্তু শরৎসন্ধ্যার নির্মল জ্যোৎস্নার দ্বারা আবিষ্ট হইয়া নড়িতে পারিতেছিল না। একটি গ্লাস বরফশীতল লেমনেড ও কুন্দফুলের মালা আনাইয়া জ্যোৎস্নাশুভ্র আকাশে সিগারেটের ধূম-সহযোগে বিচিত্র কল্পনাকুণ্ডলী নির্মাণ করিতেছিল।

শ্রীশ। আচ্ছা ভাই, শিশুপালক, তুমি কি সত্যি মনে কর আমি সন্ন্যাসী হতে পারি নে?

বিপিন। কেন পারবে না! কিন্তু অনেকগুলি তল্পিদার চেলা সঙ্গে থাকা চাই।

শ্রীশ। তার তাৎপর্য এই যে, কেউ-বা আমার বেলফুলের মালা গেঁথে দেবে, কেউ-বা বাজার থেকে লেমনেড ও বরফ ভিক্ষে করে আনবে, এই তো? তাতে ক্ষতিটা কী? যে সন্ন্যাসধর্মে বেলফুলের প্রতি বৈরাগ্য এবং ঠাণ্ডা লেমনেডের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায় সেটা কি খুব উঁচুদরের সন্ন্যাস?

0 Shares