প্রজাপতির নির্বন্ধ

বিপিন। সাধারণ ভাষায় তো সন্ন্যাসধর্ম বলতে সেইরকমটাই বোঝায়।

শ্রীশ। ঐ শোনো! তুমি কি মনে কর, ভাষায় একটা কথার একটা বৈ অর্থ নেই? একজনের কাছে সন্ন্যাসী কথাটার যে অর্থ, আর-এক জনের কাছেও যদি ঠিক সেই অর্থই হয় তা হলে মন বলে একটা স্বাধীন পদার্থ আছে কী করতে?

বিপিন। তোমার মন সন্ন্যাসী কথাটার কী অর্থ করছেন আমার মন সেইটি শোনবার জন্য উৎসুক হয়েছেন।

শ্রীশ। আমার সন্ন্যাসীর সাজ এইরকম– গলায় ফুলের মালা, গায়ে চন্দন, কানে কুণ্ডল, মুখে হাস্য। আমার সন্ন্যাসীর কাজ মানুষের চিত্ত-আকর্ষণ। সুন্দর চেহারা, মিষ্টি গলা, বক্তৃতায় অধিকার, এ-সমস্ত না থাকলে সন্ন্যাসী হয়ে উপযুক্ত ফল পাওয়া যায় না। রুচি বুদ্ধি কার্যক্ষমতা ও প্রফুল্লতা, সকল বিষয়েই আমার সন্ন্যাসীসম্প্রদায়কে গৃহস্থের আদর্শ হতে হবে।

বিপিন। অর্থাৎ, একদল কার্তিককে ময়ূরের উপর চড়ে রাস্তায় বেরোতে হবে।

শ্রীশ। ময়ূর না পাওয়া যায়, ট্রাম আছে, পদব্রজেও নারাজ নই। কুমারসভা মানেই তো কার্তিকের সভা। কিন্তু কার্তিক কি কেবল সুপুরুষ ছিলেন? তিনিই ছিলেন স্বর্গের সেনাপতি।

বিপিন। লড়াইয়ের জন্যে তাঁর দুটিমাত্র হাত, কিন্তু বক্তৃতা করবার জন্যে তাঁর তিন-জোড়া মুখ।

শ্রীশ। এর থেকে প্রমাণ হয়, আমাদের আর্য পিতামহরা বাহুবল অপেক্ষা বাক্যবলকে তিনগুণ বেশি বলেই জানতেন। আমিও পালোয়ানিকে বীরত্বের আদর্শ বলে মানি নে।

বিপিন। ওটা বুঝি আমার উপর হল?

শ্রীশ। ঐ দেখো! মানুষকে অহংকার কিরকম মাটি করে! তুমি ঠিক করে রেখেছ, পালোয়ান বললেই তোমাকে বলা হল। তুমি কলিযুগের ভীমসেন! আচ্ছা এসো, যুদ্ধং দেহি! একবার বীরত্বের পরীক্ষা হয়ে যাক।

এই বলিয়া দুই বন্ধু ক্ষণকালের জন্য লীলাচ্ছলে হাত কাড়াকাড়ি করিতে লাগিল। বিপিন হঠাৎ “এইবার ভীমসেনের পতন” বলিয়া ধপ্‌ করিয়া শ্রীশের কেদারাটা অধিকার করিয়া তাহার উপরে দুই পা তুলিয়া দিল; এবং “উঃ অসহ্য তৃষ্ণা” বলিয়া লেমনেডের গ্লাসটি এক নিশ্বাসে খালি করিল। তখন শ্রীশ তাড়াতাড়ি কুন্দফুলের মালাটি সংগ্রহ করিয়া “কিন্তু বিজয়মাল্যটি আমার” বলিয়া সেটা মাথায় জড়াইল এবং বেতের মোড়াটার উপরে বসিয়া কহিল, “আচ্ছা ভাই, সত্যি বলো, একদল শিক্ষিত লোক যদি এইরকম সংসার পরিত্যাগ করে পরিপাটি সজ্জায় প্রফুল্ল প্রসন্ন মুখে গানে এবং বক্তৃতায় ভারতবর্ষের চতুর্দিকে শিক্ষা বিস্তার করে বেড়ায় তাতে উপকার হয় কি না?”

বিপিন এই তর্কটা লইয়া বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করিতে ইচ্ছা করিল না। কহিল, “আইডিয়াটা ভালো বটে।”

শ্রীশ। অর্থাৎ, শুনতে সুন্দর কিন্তু করতে অসাধ্য! আমি বলছি অসাধ্য নয় এবং আমি দৃষ্টান্ত-দ্বারা তার প্রমাণ করব। ভারতবর্ষে সন্ন্যাসধর্ম বলে একটা প্রকাণ্ড শক্তি আছে; তার ছাই ঝেড়ে, তার ঝুলিটা কেড়ে নিয়ে, তার জটা মুড়িয়ে, তাকে সৌন্দর্যে এবং কর্মনিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত করাই চিরকুমার-সভার একমাত্র উদ্দেশ্য। ছেলে পড়ানো এবং দেশলাইয়ের কাঠি তৈরি করবার জন্যে আমাদের মতো লোক চিরজীবনের ব্রত অবলম্বন করে নি। বলো বিপিন, তুমি আমার প্রস্তাবে রাজি আছ কি না?

বিপিন। তোমার সন্ন্যাসীর যেরকম চেহারা গলা এবং আসবাবের প্রয়োজন আমার তো তার কিছুই নেই। তবে তল্পিদার হয়ে পিছনে যেতে রাজি আছি। কানে যদি সোনার কুণ্ডল, অন্তত চোখে যদি সোনার চশমাটা পরে যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াও তা হলে একটা প্রহরীর দরকার– সে কাজটা আমার দ্বারা কতকটা চলতে পারবে।

শ্রীশ। আবার ঠাট্টা!

বিপিন। না ভাই, ঠাট্টা নয়। আমি সত্যিই বলছি, তোমার প্রস্তাবটাকে যদি সম্ভবপর করে তুলতে পার তা হলে খুব ভালোই হয়। তবে এরকম একটা সম্প্রদায়ে সকলেরই কাজ সমান হতে পারে না, যার যেমন স্বাভাবিক ক্ষমতা সেই অনুসারে যোগ দিতে পারে।

শ্রীশ। সে তো ঠিক কথা। কেবল একটি বিষয়ে আমাদের খুব দৃঢ় হতে হবে, স্ত্রীজাতির কোনো সংস্রব রাখব না।

বিপিন। মাল্যচন্দন অঙ্গদকুণ্ডল সবই রাখতে চাও, কেবল ঐ একটা বিষয়ে এত বেশি দৃঢ়তা কেন?

শ্রীশ। ঐগুলো রাখছি বলেই দৃঢ়তা। যেজন্যে চৈতন্য তাঁর অনুচরদের স্ত্রীলোকের সঙ্গ থেকে কঠিন শাসনে দূরে রেখেছিলেন। তাঁর ধর্ম– অনুরাগ এবং সৌন্দর্যের ধর্ম, সেজন্যেই তার পক্ষে প্রলোভনের ফাঁদ অনেক ছিল।

বিপিন। তা হলে ভয়টুকুও আছে!

শ্রীশ। আমার নিজের জন্যে লেশমাত্র নেই। আমি আমার মনকে পৃথিবীর বিচিত্র সৌন্দর্যে ব্যাপ্ত করে রেখে দিই, কোনো একটা ফাঁদে আমাকে ধরে কার সাধ্য, কিন্তু তোমরা যে দিনরাত্রি ফুটবল টেনিস ক্রিকেট নিয়ে থাক– তোমরা একবার পড়লে ব্যাটবল গুলিডাণ্ডা সবসুদ্ধ ঘাড়মোড় ভেঙে পড়বে।

বিপিন। আচ্ছা ভাই, সময় উপস্থিত হলে দেখা যাবে।

শ্রীশ। ও কথা ভালো নয়। সময় উপস্থিত হবে না, সময় উপস্থিত হতে দেব না। সময় তো রথে চড়ে আসেন না, আমরা তাঁকে ঘাড়ে করে নিয়ে আসি– কিন্তু তুমি যে সময়টার কথা বলছ তাকে বাহন অভাবে ফিরতেই হবে।

পূর্ণর প্রবেশ

উভয়ে। এসো পূর্ণবাবু!

বিপিন তাহাকে কেদারাটা ছাড়িয়া দিয়া একটা চৌকি টানিয়া লইয়া বসিল। পূর্ণর সহিত শ্রীশ ও বিপিনের তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না বলিয়া তাহাকে দুজনেই একটু বিশেষ খাতির করিয়া চলিত।

0 Shares