প্রজাপতির নির্বন্ধ

পূর্ণ। তোমাদের এই বারান্দায় জ্যোৎস্নাটি তো মন্দ রচনা কর নি– মাঝে মাঝে থামের ছায়া ফেলে ফেলে সাজিয়েছ ভালো।

শ্রীশ। ছাদের উপর জ্যোৎস্না রচনা করা প্রভৃতি কতকগুলি অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা জন্মাবার পূর্ব হতেই আমার আছে। কিন্তু দেখো পূর্ণবাবু, ঐ দেশলাই করা-টরা ওগুলো আমার ভালো আসে না।

পূর্ণ। (ফুলের মালার দিকে চাহিয়া) সন্ন্যাসধর্মেই কি তোমার অসামান্য দখল আছে না কি?

শ্রীশ। সেই কথাই তো হচ্ছিল। সন্ন্যাসধর্ম তুমি কাকে বল শুনি।

পূর্ণ। যে ধর্মে দর্জি ধোবা নাপিতের কোনো সহায়তা নিতে হয় না, তাঁতিকে একেবারেই অগ্রাহ্য করতে হয়, পিয়ার্স্‌ সোপের বিজ্ঞাপনের দিকে দৃক্‌পাত করতে হয় না–

শ্রীশ। আরে ছিঃ, সে সন্ন্যাসধর্ম তো বুড়ো হয়ে মরে গেছে, এখন “নবীন সন্ন্যাসী’ বলে একটা সম্প্রদায় গড়তে হবে–

পূর্ণ। বিদ্যাসুন্দরের যাত্রায় যে নবীন সন্ন্যাসী আছেন তিনি মন্দ দৃষ্টান্ত নন, কিন্তু তিনি তো চিরকুমার-সভার বিধানমতে চলেন নি।

শ্রীশ। যদি চলতেন তা হলে তিনিই ঠিক দৃষ্টান্ত হতে পারতেন। সাজে সজ্জায় বাক্যে আচরণে সুন্দর এবং সুনিপুণ হতে হবে–

পূর্ণ। কেবল রাজকন্যার দিক থেকে দৃষ্টি নামাতে হবে, এই তো? বিনি-সুতোর মালা গাঁথতে হবে, কিন্তু সে মালা পরাতে হবে কার গলায় হে?

শ্রীশ। স্বদেশের। কথাটা কিছু উচ্চশ্রেণীর হয়ে পড়ল। কী করব বলো, মালিনী মাসি এবং রাজকুমারী একেবারেই নিষিদ্ধ, কিন্তু ঠাট্টা নয় পূর্ণবাবু–

পূর্ণ। ঠাট্টার মতো মোটেই শোনাচ্ছে না, ভয়ানক কড়া, কথা একেবারে খট্‌খটে শুকনো।

শ্রীশ। আমাদের চিরকুমার-সভা থেকে এমন একটি সন্ন্যাসী-সম্প্রদায় গঠন করতে হবে যারা রুচি শিক্ষা ও কর্মে সকল গৃহস্থের আদর্শ হবে। যারা সংগীত প্রভৃতি কলাবিদ্যায় অদ্বিতীয় হবে আবার লাঠি-তলোয়ার খেলা, ঘোড়ায় চড়া, বন্দুক লক্ষ করায় পারদর্শী হবে–

পূর্ণ। অর্থাৎ, মনোহরণ এবং প্রাণহরণ দুই কর্মেই মজবুত হবে। পুরুষ দেবী-চৌধুরানীর দল আর-কি।

শ্রীশ। বঙ্কিমবাবু আমার আইডিয়াটা পূর্বে হতেই চুরি করে রেখেছেন, কিন্তু ওটাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের নিজের করে নিতে হবে।

পূর্ণ। সভাপতিমশায় কী বলেন?

শ্রীশ। তাঁকে কদিন ধরে বুঝিয়ে বুঝিয়ে আমার দলে টেনে নিয়েছি। কিন্তু তিনি তাঁর দেশালাইয়ের কাঠি ছাড়েন নি। তিনি বলেন, সন্ন্যাসীরা কৃষিতত্ত্ব বস্তুতত্ত্ব প্রভৃতি শিখে গ্রামে গ্রামে চাষাদের শিখিয়ে বেড়াবে, এক টাকা করে শেয়ার নিয়ে একটা ব্যাঙ্ক্‌ খুলে বড়ো বড়ো পল্লীতে নূতন নিয়মে এক-একটা দোকান বসিয়ে আসবে– ভারতবর্ষের চারি দিকে বাণিজ্যের জাল বিস্তার করে দেবে। তিনি খুব মেতে উঠেছেন।

পূর্ণ। বিপিনবাবুর কী মত?

বিপিনের মতে শ্রীশের এই কল্পনাটি কার্যসাধ্য নয়; কিন্তু শ্রীশের সর্বপ্রকার পাগলামিকে সে স্নেহের চক্ষে দেখিত, প্রতিবাদ করিয়া শ্রীশের উৎসাহে আঘাত দিতে তাহার কোনোমতেই মন সরিত না। সে বলিল, “যদিচ আমি নিজেকে শ্রীশের নবীন সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের আদর্শ পুরুষ বলে জ্ঞান করি নে, কিন্তু দল যদি গড়ে ওঠে তো আমিও সন্ন্যাসী সাজতে রাজি আছি।”

পূর্ণ। কিন্তু সাজতে খরচ আছে মশায়। কেবল কৌপীন নয় তো– অঙ্গদ, কুণ্ডল, আভরণ, কুন্তলীন, দেলখোস–

শ্রীশ। পূর্ণবাবু, ঠাট্টাই কর আর যাই কর, চিরকুমার-সভা সন্ন্যাসীসভা হবেই। আমরা এক দিকে কঠোর আত্মত্যাগ করব, অন্য দিকে মনুষ্যত্বের কোনো উপকরণ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করব না। আমরা কঠিন শৌর্য এবং ললিত সৌন্দর্য উভয়কেই সমান আদরে বরণ করব। সেই দুরূহ সাধনায় ভারতবর্ষে নবযুগের আবির্ভাব হবে–

পূর্ণ। বুঝেছি শ্রীশবাবু! কিন্তু নারী কি মনুষ্যত্বের একটা সর্বপ্রধান উপকরণের মধ্যে গণ্য নয়? এবং তাকে উপেক্ষা করলে ললিত সৌন্দর্যের প্রতি কি সমাদর রক্ষা হবে? তার কী উপায় করলে?

শ্রীশ। নারীর একটা দোষ নরজাতিকে তিনি লতার মতো বেষ্টন করে ধরেন, যদি তাঁর দ্বারা বিজড়িত হবার আশঙ্কা না থাকত, যদি তাঁকে রক্ষা করেও স্বাধীনতা রক্ষা করা যেত, তা হলে কোনো কথা ছিল না। কাজে যখন জীবন উৎসর্গ করতে হবে তখন কাজের সমস্ত বাধা দূর করতে চাই। পাণিগ্রহণ করে ফেললে নিজের পাণিকেও বদ্ধ করে ফেলতে হবে, সে হলে চলবে না পূর্ণবাবু!

পূর্ণ। ব্যস্ত হোয়ো না ভাই, আমি আমার শুভবিবাহে তোমাদের নিমন্ত্রণ করতে আসি নি। কিন্তু ভেবে দেখো দেখি, মনুষ্যজন্ম আর পাব কি না সন্দেহ– অথচ হৃদয়কে চিরজীবন যে পিপাসার জল থেকে বঞ্চিত করতে যাচ্ছি তার পূরণস্বরূপ আর কোথাও আর কিছু জুটবে কি? মুসলমানের স্বর্গে হুরি আছে, হিন্দুর স্বর্গেও অপ্সরার অভাব নেই, চিরকুমার-সভার স্বর্গে সভাপতি এবং সভ্যমশায়দের চেয়ে মনোরম আর কিছু পাওয়া যাবে কি!

শ্রীশ। পূর্ণবাবু, বল কী? তুমি যে–

পূর্ণ। ভয় নেই ভাই, এখনো মরিয়া হয়ে উঠি নি। তোমার এই ছাদ-ভরা জ্যোৎস্না আর ঐ ফুলের গন্ধ কি কৌমার্যব্রতরক্ষার সহায়তা করবার জন্যে সৃষ্টি হয়েছে? মনের মধ্যে মাঝে মাঝে যে বাষ্প জমে আমি সেটাকে উচ্ছ্বসিত করে দেওয়াই ভালো বোধ করি, চেপে রেখে নিজেকে ভোলাতে গেলে কোন্‌ দিন চিরকুমারব্রতের লোহার বয়লারখানা ফেটে যাবে। যাই হোক, যদি সন্ন্যাসী হওয়াই স্থির কর তো আমিও যোগ দেব, কিন্তু আপাতত সভাটাকে তো রক্ষা করতে হবে।

0 Shares