প্রজাপতির নির্বন্ধ

শ্রীশ। কেন? কী হয়েছে?

পূর্ণ। অক্ষয়বাবু আমাদের সভাকে যে স্থানান্তর করবার ব্যবস্থা করছেন এটা আমার ভালো ঠেকছে না।

শ্রীশ। সন্দেহ জিনিসটা নাস্তিকতার ছায়া। মন্দ হবে, ভেঙে যাবে, নষ্ট হবে, এ-সব ভাব আমি কোনো অবস্থাতেই মনে স্থান দিই নে। ভালোই হবে, যা হচ্ছে বেশ হচ্ছে– চিরকুমার-সভার উদার বিস্তীর্ণ ভবিষ্যৎ আমি চোখের সম্মুখে দেখতে পাচ্ছি– অক্ষয়বাবু সভাকে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে তার কী অনিষ্ট করতে পারেন? কেবল গলির এক নম্বর থেকে আর-এক নম্বরে নয়, আমাদের যে পথে পথে দেশে দেশে সঞ্চরণ করে বেড়াতে হবে। সন্দেহ শঙ্কা উদ্‌বেগ এগুলো মন থেকে দূর করে দাও পূর্ণবাবু! বিশ্বাস এবং আনন্দ না হলে বড়ো কাজ হয় না।

পূর্ণ নিরুত্তর হইয়া বসিয়া রহিল। বিপিন কহিল, “দিনকতক দেখাই যাক-না, যদি কোনো অসুবিধার কারণ ঘটে তা হলে স্বস্থানে ফিরে আসা যাবে; আমাদের সেই অন্ধকার বিবরটি ফস্‌ করে কেউ কেড়ে নিচ্ছে না।”

হায়, পূর্ণের হৃদয়বেদনা কে বুঝিবে?

অকস্মাৎ চন্দ্রমাধববাবুর সবেগে প্রবেশ

তিনজনের সসম্ভ্রমে উত্থান

চন্দ্র। দেখো, আমি সেই কথাটা ভাবছিলুম–

শ্রীশ। বসুন।

চন্দ্র। না না, বসব না, আমি এখনই যাচ্ছি। আমি বলছিলুম, সন্ন্যাসব্রতের জন্যে আমাদের এখন থেকে প্রস্তুত হতে হবে। হঠাৎ একটা অপঘাত ঘটলে, কিম্বা সাধারণ জরজ্বালায়, কিরকম চিকিৎসা সে আমাদের শিক্ষা করতে হবে– ডাক্তার রামরতনবাবু ফি রবিবারে আমাদের দু ঘণ্টা করে বক্তৃতা দেবেন বন্দোবস্ত করে এসেছি।

শ্রীশ। কিন্তু তাতে অনেক বিলম্ব হবে না?

চন্দ্র। বিলম্ব তো হবেই, কাজটি তো সহজ নয়। কেবল তাই নয়– আমাদের কিছু কিছু আইন অধ্যয়নও দরকার। অবিচার-অত্যাচার থেকে রক্ষা করা, এবং কার কতদূর অধিকার সেটা চাষাভুষোদের বুঝিয়ে দেওয়া আমাদের কাজ।

শ্রীশ। চন্দ্রবাবু, বসুন–

চন্দ্র। না শ্রীশবাবু, বসতে পারছি নে, আমার একটু কাজ আছে। আর-একটি আমাদের করতে হচ্ছে– গোরুর গাড়ি, ঢেঁকি, তাঁত প্রভৃতি আমাদের দেশী অত্যাবশ্যক জিনিসগুলিকে একটু-আধটু সংশোধন করে যাতে কোনো অংশে তাদের সস্তা বা মজবুত বা বেশি উপযোগী করে তুলতে পারি সে চেষ্টা আমাদের করতে হবে। এবারে গরমির ছুটিতে কেদারবাবুদের কারখানায় গিয়ে প্রত্যহ আমাদের কতকগুলি পরীক্ষা করা চাই।

শ্রীশ। চন্দ্রবাবু, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন–

[চৌকি অগ্রসর-করণ

চন্দ্র। না, না, আমি এখনই যাচ্ছি। দেখো আমার মত এই যে, এই-সমস্ত গ্রামের ব্যবহার্য সামান্য জিনিসগুলির যদি আমরা কোনো উন্নতি করতে পারি তা হলে তাতে করে চাষাদের মনের মধ্যে যেরকম আন্দোলন হবে, বড়ো বড়ো সংস্কারকার্যেও তেমন হবে না। তাদের সেই চিরকেলে ঢেঁকি-ঘানির কিছু পরিবর্তন করতে পারলে তবে তাদের সমস্ত মন সজাগ হয়ে উঠবে, পৃথিবী যে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই এ তারা বুঝতে পারবে–

শ্রীশ। চন্দ্রবাবু, বসবেন না কি?

চন্দ্র। থাক্‌ না। একবার ভেবে দেখো, আমরা যে এতকাল ধরে শিক্ষা পেয়ে আসছি, উচিত ছিল আমাদের ঢেঁকি-কুলো থেকে তার পরিচয় আরম্ভ হওয়া। বড়ো বড়ো কলকারখানা তো দূরের কথা, ঘরের মধ্যেই আমাদের সজাগ দৃষ্টি পড়ল না। আমাদের হাতের কাছে যা আছে আমরা না তার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলুম, না তার সম্বন্ধে কিছুমাত্র চিন্তা করলুম। যা ছিল তা তেমনিই রয়ে গেছে। মানুষ অগ্রসর হচ্ছে অথচ তার জিনিসপত্র পিছিয়ে থাকছে, এ কখনো হতেই পারে না। আমরা পড়েই আছি– ইংরেজ আমাদের কাঁধে করে বহন করছে, তাকে এগোনো বলে না। ছোটোখাটো সামান্য গ্রাম্য জীবনযাত্রা পল্লীগ্রামের পঙ্কিল পথের মধ্যে বদ্ধ হয়ে অচল হয়ে আছে, আমাদের সন্ন্যাসী-সম্প্রদায়কে সেই গোরুর গাড়ির চাকা ঠেলতে হবে– কলের গাড়ির চালক হবার দুরাশা এখন থাক। কটা বাজল শ্রীশবাবু?

শ্রীশ। সাড়ে আটটা বেজে গেছে।

চন্দ্র। তা হলে আমি যাই। কিন্তু এই কথা রইল, আমাদের এখন অন্য সমস্ত আলোচনা ছেড়ে নিয়মিত শিক্ষাকার্যে প্রবৃত্ত হতে হবে এবং–

পূর্ণ। আপনি যদি একটু বসেন চন্দ্রবাবু তা হলে আমার দুই-একটা কথা বলবার আছে।–

চন্দ্র। না, আজ আর সময় নেই।

পূর্ণ। বেশি কিছু নয়, আমি বলছিলুম আমাদের সভা–

চন্দ্র। সে কথা কাল হবে পূর্ণবাবু–

পূর্ণ। কিন্তু কালই তো সভা বসছে–

চন্দ্র। আচ্ছা, তা হলে পরশু, আমার সময় নেই–

পূর্ণ। দেখুন, অক্ষয়বাবু যে–

চন্দ্র। পূর্ণবাবু, আমাকে মাপ করতে হবে, আজ দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু দেখো, আমার একটা কথা মনে হচ্ছিল যে, চিরকুমার-সভা যদি ক্রমে বিস্তীর্ণ হয়ে পড়ে তা হলে আমাদের সকল সভ্যই কিছু সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যেতে পারবেন না– অতএব ওর মধ্যে দুটি বিভাগ রাখা দরকার হবে–

পূর্ণ। স্থাবর এবং জঙ্গম।

চন্দ্র। তা, সে যে নামই দাও। তা ছাড়া অক্ষয়বাবু সেদিন একটি কথা যা বললেন সেও আমার মন্দ লাগল না। তিনি বলেন, চিরকুমার-সভার সংস্রবে আর-একটি সভা রাখা উচিত যাতে বিবাহিত এবং বিবাহসংকল্পিত লোকদের নেওয়া যেতে পারে। গৃহী লোকদেরও তো দেশের প্রতি কর্তব্য আছে। সকলেরই সাধ্যমত কোনো-না-কোনো হিতকর কাজে নিযুক্ত থাকতে হবে– এইটে হচ্ছে সাধারণ ব্রত। আমাদের একদল কুমারব্রত ধারণ করে দেশে দেশে বিচরণ করবেন, একদল কুমারব্রত ধারণ করে এক জায়গায় স্থায়ী হয়ে বসে কাজ করবেন, আর-এক দল গৃহী নিজ নিজ রুচি ও সাধ্য-অনুসারে একটা কোনো প্রয়োজনীয় কাজ অবলম্বন করে দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করবেন। যাঁরা পর্যটকসম্প্রদায়ভুক্ত হবেন তাঁদের ম্যাপ প্রস্তুত, জরিপ, ভূতত্ত্ববিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিতত্ত্ব প্রভৃতি শিখতে হবে; তাঁরা যে দেশে যাবেন সেখানকার সমস্ত তথ্য তন্ন তন্ন করে সংগ্রহ করবেন– তা হলেই ভারতবর্ষীয়ের দ্বারা ভারতবর্ষের যথার্থ বিবরণ লিপিবদ্ধ হবার ভিত্তি স্থাপিত হতে পারবে– হন্টার সাহেবের উপরেই নির্ভর করে কাটাতে হবে না–

0 Shares