প্রজাপতির নির্বন্ধ

অক্ষয় প্রস্থান করিলেন। ঘরে দুটি কেরোসিনের দীপ জ্বলিতেছে; সেই দুটিকে বেষ্টন করিয়া ফিরোজ রঙের রেশমের অবগুণ্ঠন। সেই আবরণ ভেদ করিয়া ঘরের আলোটি মৃদু এবং রঙিন হইয়া উঠিয়াছে।

পুরুষবেশী শৈল আসিয়া সকলকে নমস্কার করিল। ক্ষীণদৃষ্টি চন্দ্রমাধববাবু ঝাপসাভাবে তাহাকে দেখিলেন– বিপিন ও শ্রীশ তাহার দিকে চাহিয়া রহিল।

শৈলের পশ্চাতে দুইজন ভৃত্য কয়েকটি ভোজনপাত্র হাতে করিয়া উপস্থিত হইল। শৈল ছোটো ছোটো রুপার থালাগুলি লইয়া সাদা পাথরের টেবিলের উপর সাজাইতে লাগিল। প্রথম পরিচয়ের দুর্নিবার লজ্জাটুকু সে এইরূপ আতিথ্যব্যাপারের মধ্যে ঢাকিয়া লইবার চেষ্টা করিল।

রসিক কহিলেন, “ইনি আপনাদের সভার আর একটি নবীন সভ্য। এঁর নবীনতা সম্বন্ধে কোনো তর্ক নেই। ঠিক আমার বিপরীত। ইনি বুদ্ধির প্রবীণতা বাহ্য নবীনতা দিয়ে গোপন করে রেখেছেন। আপনারা কিছু বিস্মিত হয়েছেন দেখছি– হবার কথা। এঁকে দেখে মনে হয় বালক, কিন্তু আমি আপনাদের কাছে জামিন রইলুম– ইনি বালক নন।”

চন্দ্র। এঁর নাম?

রসিক। শ্রীঅবলাকান্ত চট্টোপাধ্যায়।

শ্রীশ বলিয়া উঠিল, “অবলাকান্ত?”

রসিক। নামটি আমাদের সভার উপযোগী নয় স্বীকার করি। নামটির প্রতি আমারও বিশেষ মমত্ব নেই– যদি পরিবর্তন করে বিক্রমসিংহ বা ভীমসেন বা অন্য কোনো উপযুক্ত নাম রাখেন তাতে উনি আপত্তি করবেন না। যদিচ শাস্ত্রে আছে বটে “স্বনামা পুরুষো ধন্যঃ’, কিন্তু উনি অবলাকান্ত নামটির দ্বারাই জগতে পৌরুষ অর্জন করতে ব্যাকুল নন।

শ্রীশ কহিল, “বলেন কী মশায়! নাম তো আর গায়ের বস্ত্র নয়, যে বদল করলেই হল।”

রসিক। ওটা আপনাদের একেলে সংস্কার শ্রীশবাবু। নামটাকে প্রাচীনেরা পোশাকের মধ্যেই গণ্য করতেন। দেখুন-না কেন, অর্জুনের পিতৃদত্ত নাম কী ঠিক করে বলা শক্ত– পার্থ, ধনঞ্জয়, সব্যসাচী, লোকের যখন যা মুখে আসত তাই বলেই ডাকত। দেখুন নামটাকে আপনারা বেশি সত্য মনে করবেন না; ওঁকে যদি ভুলে আপনি অবলাকান্ত না’ও বলেন উনি লাইবেলের মোকদ্দমা আনবেন না।

শ্রীশ হাসিয়া কহিল, “আপনি যখন এতটা অভয় দিচ্ছেন তখন অত্যন্ত নিশ্চিন্ত হলুম, কিন্তু ওঁর ক্ষমাগুণের পরিচয় নেবার দরকার হবে না– নাম ভুল করব না মশায়।”

রসিক। আপনি না করতে পারেন, কিন্তু আমি করি মশায়। উনি আমার সম্পর্কে নাতি হন– সেইজন্যে ওঁর সম্বন্ধে আমার রসনা কিছু শিথিল, যদি কখনো এক বলতে আর বলি সেটা মাপ করবেন।

শ্রীশ উঠিয়া কহিল, “অবলাকান্তবাবু, আপনি এ-সমস্ত কী আয়োজন করেছেন? আমাদের সভার কার্যাবলীর মধ্যে মিষ্টান্নটা ছিল না।”

রসিক। (উঠিয়া) সেই ত্রুটি যিনি সংশোধন করছেন তাঁকে সভার হয়ে ধন্যবাদ দিই।

শ্রীশের মুখের দিকে না চাহিয়া থালা সাজাইতে সাজাইতে শৈল কহিল, “শ্রীশবাবু, আহারটাও কী আপনাদের নিয়মবিরুদ্ধ?”

শ্রীশ দেখিল কণ্ঠস্বরটিও অবলা নামের উপযুক্ত। কহিল, “এই সভ্যটির আকৃতি নিরীক্ষণ করে দেখলেই ও সম্বন্ধে কোনো সংশয় থাকবে না।”

বলিয়া বিপুলায়তন বিপিনকে টানিয়া আনিল।

বিপিন কহিল, “নিয়মের কথা যদি বলেন অবলাকান্তবাবু, সংসারের শ্রেষ্ঠ জিনিসমাত্রই নিজের নিয়ম নিজে সৃষ্টি করে। ক্ষমতাশালী লেখক নিজের নিয়মে চলে, শ্রেষ্ঠ কাব্য সমালোচকের নিয়ম মানে না। যে মিষ্টান্নগুলি সংগ্রহ করেছেন এর সম্বন্ধেও কোনো সভার নিয়ম খাটতে পারে না– এর একমাত্র নিয়ম, বসে যাওয়া এবং নিঃশেষ করা। ইনি যতক্ষণ আছেন ততক্ষণ জগতের অন্য সমস্ত নিয়মকে দ্বারের কাছে অপেক্ষা করতে হবে।”

শ্রীশ কহিল, “তোমার হল কী বিপিন? তোমাকে খেতে দেখেছি বটে, কিন্তু এক নিশ্বাসে এত কথা কইতে শুনি নি তো।”

বিপিন। রসনা উত্তেজিত হয়েছে, এখন সরল বাক্য বলা আমার পক্ষে অত্যন্ত সহজ হয়েছে। যিনি আমার জীবনবৃত্তান্ত লিখবেন, হায়, এ সময়ে তিনি কোথায়?

রসিক টাকে হাত বুলাইতে বুলাইতে কহিলেন, “আমার দ্বারা সে কাজটা প্রত্যাশা করবেন না, আমি অত দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে পারব না।”

নূতন ঘরের বিলাসসজ্জার মধ্যে আসিয়া চন্দ্রমাধববাবুর মনটা বিক্ষিপ্ত হইয়া গিয়াছিল। তাঁহার উৎসাহস্রোত যথাপথে প্রবাহিত হইতেছিল না। তিনি ক্ষণে ক্ষণে কার্যবিবরণের খাতা, ক্ষণে ক্ষণে নিজের করকোষ্ঠী অকারণে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতেছিলেন। শৈল তাঁহার সম্মুখে গিয়া সবিনয়ে নিবেদন করিল, “সভার কার্যের যদি কিছু ব্যাঘাত করে থাকি তো মাপ করবেন, চন্দ্রবাবু, কিছু জলযোগ–”

চন্দ্রবাবু শৈলকে নিকটে পাইয়া তাহার মুখ নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, “এ-সমস্ত সামাজিকতায় সভার কার্যের ব্যাঘাত করে, তাতে সন্দেহ নেই।”

রসিক কহিলেন, “আচ্ছা, পরীক্ষা করে দেখুন মিষ্টান্নে যদি সভার কার্য রোধ হয় তা হলে–”

বিপিন মৃদুস্বরে কহিল, “তা হলে ভবিষ্যতে না হয় সভাটা বন্ধ রেখে মিষ্টান্নটা চালালেই হবে।”

চন্দ্রবাবু নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে দেখিতে শৈলের সুন্দর সুকুমার চেহারাটি কিয়ৎপরিমাণে আয়ত্ত করিয়া লইলেন। তখন শৈলকে ক্ষুণ্ন করিতে তাঁহার আর প্রবৃত্তি হইল না।

বলা আবশ্যক, অচিরকাল পূর্বেই বিপিন জলযোগ করিয়াই বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছিল। তাহার ভোজনের ইচ্ছামাত্র ছিল না, কিন্তু এই প্রিয়দর্শন কুমারটিকে দেখিয়া, বিশেষত তাহার মুখের অত্যন্ত কোমল একটি স্মিতহাস্যে, বিপুলবলশালী বিপিনের চিত্ত হঠাৎ এমনি স্নেহাকৃষ্ট হইয়া পড়িল যে, অস্বাভাবিক মুখরতার সহিত মিষ্টান্নের প্রতি সে অতিরিক্ত লোলুপতা প্রকাশ করিল। রোগভীরু শ্রীশের অসময়ে খাইবার সাহস ছিল না, তাহারও মনে হইল, না খাইতে বসিলে এই তরুণ কুমারটির প্রতি কঠিন রূঢ়তা করা হইবে।

0 Shares