প্রজাপতির নির্বন্ধ

কদাহং সেবিষ্যে কিসলয়কলাপব্যজনিনী।

শ্রীশ। বেশ বেশ রসিকবাবু, চমৎকার! কিন্তু ওর মানেটা বলে দিতে হবে। ছন্দের ভিতর দিয়ে ওর রসের গন্ধটা পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু অনুস্বার বিসর্গ দিয়ে একেবারে এঁটে বন্ধ করে রেখেছে।

রসিক। বাংলায় একটা তর্জমাও করেছি, পাছে সম্পাদকরা খবর পেয়ে হুড়াহুড়ি লাগিয়ে দেয় তাই লুকিয়ে রেখেছি– শুনবেন শ্রীশবাবু?

কুঞ্জকুটিরের স্নিগ্ধ অলিন্দের ‘পর

কালিন্দীকমলগন্ধ ছুটিবে সুন্দর।

লীনা রবে মদিরাক্ষী তব অঙ্কতলে,

বহিবে বাসন্তীবাস ব্যাকুল কুন্তলে।

তাঁহারে করিব সেবা, কবে হবে হায়–

কিশলয়-পাখাখানি দোলাইব গায়?

শ্রীশ। বা, বা, রসিকবাবু, আপনার মধ্যে এত আছে তা তো জানতুম না।

রসিক। কী করে জানবেন বলুন। কাব্যলক্ষ্মী যে তাঁর পদ্মবন থেকে মাঝে মাঝে এই টাকের উপরে খোলা হাওয়া খেতে আসেন এ কেউ সন্দেহ করে না। (হাত বুলাইয়া) কিন্তু এমন ফাঁকা জায়গা আর নেই!

শ্রীশ। আহাহা রসিকবাবু, যমুনাতীরে সেই স্নিগ্ধ অলিন্দওয়ালা কুঞ্জকুটিরটি আমার ভারি মনে লেগে গেছে। যদি পায়োনিয়রে বিজ্ঞাপন দেখি সেটা দেনার দায়ে নিলেমে বিক্রি হচ্ছে তা হলে কিনে ফেলি।

রসিক। বলেন কী শ্রীশবাবু! শুধু অলিন্দ নিয়ে করবেন কী? সেই মদ-মুকুলিতাক্ষীর কথাটা ভেবে দেখবেন। সে নিলেমে পাওয়া শক্ত।

শ্রীশ। কার রুমাল এখানে পড়ে রয়েছে।

রসিক। দেখি দেখি! তাই তো! দুর্লভ জিনিস আপনার হাতে ঠেকে দেখছি! বাঃ, দিব্যি গন্ধ? শ্লোকের লাইনটা বদলাতে হবে মশায়, ছন্দোভঙ্গ হয় হোক গে– বাসন্তীনবপরিমলোদ্‌গাররুমালাং! শ্রীশবাবু, এ রুমালটাতে তো আমাদের কুমারসভার পতাকা-নির্মাণ চলবে না। দেখেছেন, কোণে কেটি ছোট্ট “ন’ অক্ষর লেখা রয়েছে?

শ্রীশ। কী নাম হতে পারে বলুন দেখি? নলিনী? না, বড্ড চলিত নাম। নীলাম্বুজা? ভয়ংকর মোটা। নীহারিকা? বড়ো বাড়াবাড়ি। বলুন-না রসিকবাবু, আপনার কী মনে হয়?

রসিক। নাম মনে হয় না মশায়, আমার ভাব মনে আসে। অভিধানে যত “ন’ আছে সমস্ত মাথার মধ্যে রাশীকৃত হয়ে উঠতে চাচ্ছে, “ন’য়ের মালা গেঁথে একটি নীলোৎপলনয়নার গলায় পরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে– নির্মলনবনীনিন্দিতনবীন– বলুন-না শ্রীশবাবু– শেষ করে দিন-না–

শ্রীশ। নবমল্লিকা।

রসিক। বেশ বেশ– নির্মলনবনীনিন্দিতনবীননবমল্লিকা! গীতগোবিন্দ মাটি হল। আরো অনেকগুলো ভালো ভালো “ন’ মাথার মধ্যে হাহাকার করে বেড়াচ্ছে, মিলিয়ে দিতে পারছি নে– নিভৃত নিকুঞ্জনিলয়, নিপুণনূপুরনিক্কণ, নিবিড়নীরদনির্মুক্ত– অক্ষয়দাদা থাকলে ভাবতে হত না। মাস্টারমশায়কে দেখবামাত্র ছেলেগুলো যেমন বেঞ্চে নিজ নিজ স্থানে সার বেঁধে বসে– তেমনি অক্ষয়দাদার সাড়া পাবামাত্র কথাগুলো দৌড়ে এসে জুড়ে দাঁড়ায়।– শ্রীশবাবু, বুড়োমানুষকে বঞ্চনা করে রুমালখানা চুপিচুপি পকেটে পুরবেন না–

শ্রীশ। আবিষ্কারকর্তার অধিকার সকলের উপর–

রসিক। আমার ঐ রুমালখানিতে একটু প্রয়োজন আছে শ্রীশবাবু! আপনাকে তো বলেছি, আমার নির্জন ঘরের একটিমাত্র জানলা দিয়ে একটুমাত্র চাঁদের আলো আসে– আমার একটি কবিতা মনে পড়ে–

বীথীষু বীথীষু বিলাসিনীনাং

মুখানি সংবীক্ষ্য শুচিস্মিতানি

জালেষু জালেষু করং প্রসার্য

লাবণ্যভিক্ষামটতীব চন্দ্রঃ।

কুঞ্জ পথে পথে চাঁদ উঁকি দেয় আসি,

দেখে বিলাসিনীদের মুখভরা হাসি,

কর প্রসারণ করি ফিরে সে জাগিয়া

বাতায়নে বাতায়নে লাবণ্য মাগিয়া।

হতভাগা ভিক্ষুক আমার বাতায়নটায় যখন আসে তখন তাকে কী দিয়ে ভোলাই বলুন তো! কাব্যশাস্ত্রের রসালো জায়গা যা-কিছু মনে আসে সমস্ত আউড়ে যাই, কিন্তু কথায় চিঁড়ে ভেজে না। সেই দুর্ভিক্ষের সময় ঐ রুমালখানি বড়ো কাজে লাগবে। ওতে অনেকটা লাবণ্যের সংস্রব আছে।

শ্রীশ। সে লাবণ্য দৈবাৎ কখনো দেখেছেন রসিকবাবু?

রসিক। দেখেছি বৈকি, নইলে কি ঐ রুমালখানার জন্যে এত লড়াই করি? আর ঐ যে “ন’ অক্ষরের কথাগুলো আমার মাথার মধ্যে এখনো এক ঝাঁক ভ্রমরের মতো গুঞ্জন করে বেড়াচ্ছে তাদের সামনে কি একটি কমলবনবিহারিণী মানসীমূর্তি নেই?

শ্রীশ। রসিকবাবু, আপনার ঐ মগজটি একটি মৌচাকবিশেষ, ওর ফুকরে ফুকরে কবিত্বের মধু– আমাকে সুদ্ধ মাতাল করে দেবেন দেখছি।

[দীর্ঘনিশ্বাসপতন

পুরুষবেশী শৈলবালার প্রবেশ

শৈল। আমার আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল, মাপ করবেন শ্রীশবাবু!

শ্রীশ। আমি এই সন্ধেবেলায় উৎপাত করতে এলুম, আমাকেও মাপ করবেন অবলাকান্তবাবু!

শৈল। রোজ সন্ধেবেলায় যদি এইরকম উৎপাত করেন তা হলে মাপ করব, নইলে নয়।

শ্রীশ। আচ্ছা রাজি, কিন্তু এর পরে যখন অনুতাপ উপস্থিত হবে তখন প্রতিজ্ঞা স্মরণ করবেন।

শৈল। আমার জন্যে ভাববেন না, কিন্তু আপনার যদি অনুতাপ উপস্থিত হয় তা হলে আপনাকে নিষ্কৃতি দেব।

শ্রীশ। সেই ভরসায় যদি থাকেন তা হলে অনন্তকাল অপেক্ষা করতে হবে।

শৈল। রসিকদাদা, তুমি শ্রীশবাবুর পকেটের দিকে হাত বাড়াচ্ছ কেন? বুড়োবয়সে গাঁটকাটা ব্যাবসা ধরবে না কি?

রসিক। না ভাই, সে ব্যাবসা তোদের বয়সেই শোভা পায়। একখানা রুমাল নিয়ে শ্রীশবাবুতে আমাতে তক্‌রার চলছে, তোকে তার মীমাংসা করে দিতে হবে।

শৈল। কিরকম?

রসিক। প্রেমের বাজারে বড়ো মহাজনি কারবার মূলধন আমার নেই, আমি খুচরো মালের কারবারী– রুমালটা, চুলের দড়িটা, ছেঁড়া কাগজে দু-চারটে হাতের অক্ষর, এই-সমস্ত কুড়িয়ে-বাড়িয়েই আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। শ্রীশবাবুর যেরকম মূলধন আছে তাতে উনি বাজারসুদ্ধ পাইকেরি দরে কিনে নিতে পারেন, রুমাল কেন সমস্ত নীলাঞ্চলে অর্ধেক ভাগ বসাতে পারেন; আমরা যেখানে চুলের দড়ি গলায় জড়িয়ে মরতে ইচ্ছে করি উনি যে সেখানে আগুল্‌ফবিলম্বিত চিকুররাশির সুগন্ধ ঘনান্ধকারের মধ্যে সম্পূর্ণ অস্ত যেতে পারেন। উনি উঞ্ছবৃত্তি করতে আসেন কেন?

0 Shares