প্রজাপতির নির্বন্ধ

শ্রীশ। এবং তার সঙ্গে যেন কিঞ্চিৎ ঝালের সম্পর্কও থাকে–

বিপিন। এবং বাক্যবর্ষণ করেই যেন মুখের সমস্ত কর্তব্য নিঃশেষ না হয়–

পূর্ণ। বাক্যের বিরামস্থলগুলি যেন বাক্যের চেয়ে মধুমত্তর হয়ে ওঠে।

শ্রীশ। সেদিন নিদ্রা যেন না আসে–

পূর্ণ। রাত্রি যেন না যায়–

বিপিন। চন্দ্র যেন পূর্ণচন্দ্র হয়–

পূর্ণ। বিপিন যেন বসন্তের ফুলে প্রফুল্ল হয়ে ওঠে–

শ্রীশ। এবং হতভাগ্য শ্রীশ যেন কুঞ্জদ্বারের কাছে এসে উঁকিঝুঁকি না মারে।

পূর্ণ। দূর হোক গে শ্রীশবাবু, তোমার সেই আবাহন থেকে আর-একটা কিছু কবিতা আওড়াও। চমৎকার লিখেছে হে–

নিশি না পোহাতে জীবনপ্রদীপ

জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া!

আহা! একটি জীবনপ্রদীপের শিখাটুকু আর-একটি জীবনপ্রদীপের মুখের কাছে কেবল একটু ঠেকিয়ে গেলেই হয়, বাস্‌, আর কিছুই নয়– দুটি কোমল অঙ্গুলি দিয়ে প্রদীপখানি একটু হেলিয়ে একটু ছুঁইয়ে যাওয়া, তার পরেই চকিতের মধ্যে সমস্ত আলোকিত। (আপন-মনে)–

নিশি না পোহাতে জীবনপ্রদীপ

জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া!

শ্রীশ। পূর্ণবাবু, যাও কোথায়!

পূর্ণ। চন্দ্রবাবুর বাসায় একখানা বই ফেলে এসেছি, সেইটে খুঁজতে যাচ্ছি।

বিপিন। খুঁজলে পাবে তো? চন্দ্রবাবুর বাসা বড়ো এলোমেলো জায়গা– সেখানে যা হারায় সে আর পাওয়া যায় না।

[পূর্ণের প্রস্থান

শ্রীশ। (দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া) পূর্ণ বেশ আছে ভাই বিপিন!

বিপিন। ভিতরকার বাষ্পের চাপে ওর মাথাটা সোডাওয়াটারের ছিপির মতো একেবারে টপ্‌ করে উড়ে না যায়!

শ্রীশ। যায় তো যাক-না। কোনোমতে লোহার তার এঁটে মাথাটাকে ঠিক জায়গায় ধরে রাখাই কি জীবনের চরম পুরুষার্থ? মাঝে মাঝে মাথার বেঠিক না হলে রাতদিন মুটের বোঝার মতো মাথাটাকে বয়ে বেড়াচ্ছি কেন? দাও ভাই, তার কেটে, একবার উড়ুক।– সেদিন তোমাকে শোনাচ্ছিলুম–

ওরে সাবধানী পথিক, বারেক

পথ ভুলে মর্‌ ফিরে।

খোলা আঁখি দুটো অন্ধ করে দে

আকুল আঁখির নীরে।

সে ভোলা পথের প্রান্তে রয়েছে

হারানো হিয়ার কুঞ্জ,

ঝরে পড়ে আছে কাঁটাতরুতলে

রক্তকুসুমপুঞ্জ–

সেথা দুই বেলা ভাঙা-গড়া খেলা

অকূলসিন্ধুতীরে।

ওরে সাবধানী পথিক, বারেক

পথ ভুলে মর্‌ ফিরে।

বিপিন। আজকাল তুমি খুব কবিতা পড়তে আরম্ভ করেছ, শীঘ্রই একটা মুশকিলে পড়বে দেখছি!

শ্রীশ। যে লোক ইচ্ছে করে মুশকিলের রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছে তার জন্যে কেউ ভেবো না। মুশকিলকে এড়িয়ে চলতে গিয়ে হঠাৎ মুশকিলের মধ্যে পা ফেললেই বিপদ।– আসুন আসুন রসিকবাবু, রাত্রে পথে বেরিয়েছেন যে?

রসিকের প্রবেশ

রসিক। আমার রাতই বা কী, আর দিনই বা কী!

বরমসৌ দিবসো ন পুনর্নিশা

ননু নিশৈব বরং ন পুনর্দিনম্‌।

উভয়মেতদুপৈত্বথবা ক্ষয়ং

প্রিয়জনেন ন যত্র সমাগমঃ।

শ্রীশ। অস্যার্থঃ?

রসিক। অস্যার্থ হচ্ছে–

আসে তো আসুক রাতি, আসুক বা দিবা,

যায় যদি যাক নিরবধি।

তাহাদের যাতায়াতে আসে যায় কিবা

প্রিয় মোর নাহি আসে যদি।

অনেকগুলো দিন রাত এ-পর্যন্ত এসেছে এবং গেছে, কিন্তু তিনি আজ পর্যন্ত এসে পৌঁছলেন না– তাই, দিনই বলুন আর রাতই বলুন, ও দুটোর ‘পরে আমার আর কিছুমাত্র শ্রদ্ধা নেই।

শ্রীশ। আচ্ছা রসিকবাবু, প্রিয়জন এখনই যদি হঠাৎ এসে পড়েন?

রসিক। তা হলে আমার দিকে তাকাবেন না, তোমাদের দুজনের মধ্যে একজনের ভাগেই পড়বেন!

শ্রীশ। তা হলে তদ্দণ্ডেই তিনি অরসিক বলে প্রকাশ হয়ে যাবেন।

রসিক। এবং পরদণ্ডেই পরমানন্দে কালযাপন করতে থাকবেন। তা, আমি ঈর্ষা করতে চাই নে শ্রীশবাবু! আমার ভাগ্যে যিনি আসতে বহু বিলম্ব করলেন, আমি তাঁকে তোমাদের উদ্দেশেই উৎসর্গ করলুম। দেবী, তোমার বরমাল্য গেঁথে আনো। আজ বসন্তের শুক্ল রজনী, আজ অভিসারে এসো!

মন্দং নিধেহি চরণৌ পরিধেহি নীলং

বাসঃ পিধেহি বলয়াবলিমঞ্চলেন।

মা জল্প সাহসিনি শারদচন্দ্রকান্ত-

দন্তাংশবস্তব তমাংসি সমাপয়ন্তি।

ধীরে ধীরে চলো তন্বী, পরো নীলাম্বর,

অঞ্চলে বাঁধিয়া রাখো কঙ্কণ মুখর।

কথাটি কোয়ো না, তব দন্ত-অংশুরুচি

পথের তিমিররাশি পাছে ফেলে মুছি।

শ্রীশ। রসিকবাবু, আপনার ঝুলি যে একেবারে ভরা। এমন কত তর্জমা করে রেখেছেন?

রসিক। বিস্তর– লক্ষ্মী তো এলেন না, কেবল বাণীকে নিয়েই দিন যাপন করছি।

শ্রীশ। ওহে বিপিন, অভিসার ব্যাপারটা কল্পনা করতে বেশ লাগে।

বিপিন। ওটা পুনর্বার চালাবার জন্যে চিরকুমার-সভায় একটা প্রস্তাব এনে দেখো-না।

শ্রীশ। কতকগুলো জিনিস আছে যার আইডিয়াটা এত সুন্দর যে, সংসারে সেটা চালাতে সাহস হয় না। যে রাস্তায় অভিসার হতে পারে, যেখানে কামিনীদের হার থেকে মুক্তো ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়ে, সে রাস্তা কি তোমার পটোলডাঙা স্ট্রীট? সে রাস্তা জগতে কোথাও নেই। বিরহিণীর হৃদয় নীলাম্বরী প’রে মনোরাজ্যের পথে ঐরকম করে বেরিয়ে থাকে– বক্ষের উপর থেকে মুক্তো ছিঁড়ে পড়ে, চেয়েও দেখে না– সত্যিকার মুক্তো হলে কুড়িয়ে নিত। কী বলেন রসিকবাবু?

রসিক। সে কথা মানতেই হয়– অভিসারটা মনে মনেই ভালো, গাড়ি-ঘোড়ার রাস্তায় অত্যন্ত বেমানান। আশীর্বাদ করি শ্রীশবাবু, এইরকম বসন্তের জ্যোৎস্নারাত্রে কোনো-একটি জানলা থেকে কোনো-এক রমণীর ব্যাকুল হৃদয় তোমার বাসার দিকে যেন অভিসারে যাত্রা করে।

0 Shares