প্রজাপতির নির্বন্ধ

রসিক। এ তো নৃপবালাই বটে! পা দুখানি লজ্জিত, হাত দুখানি কুণ্ঠিত, চোখ দুটি ত্রস্ত, চুলগুলি কুঞ্চিত, দুঃখের বিষয় হৃদয়টি দেখতে পান নি– সে যেন ফুলের ভিতরকার লুকোনো মধুটুকুর মতো মধুর, শিশিরটুকুর মতো করুণ।

শ্রীশ। রসিকবাবু, আপনার মধ্যে এত যে কবিত্বরস সঞ্চিত হয়ে রয়েছে তার উৎস কোথায় এবার টের পেয়েছি।

রসিক। ধরা পড়েছি শ্রীশবাবু–

কবীন্দ্রাণাং চেতঃকমলবনমালাতপরুচিং

ভজন্তে যে সন্তঃ কতিচিদরুণামেব ভবতীং

বিরিঞ্চিপ্রেয়স্যাস্তরুণতরশৃঙ্গারলহরীং

গভীরাভির্বাগ্‌ভির্বিদধাতি সভারঞ্জনময়ীম্‌।

কবীন্দ্রদের চিত্তকমলবনমালার কিরণলেখা যে তুমি, তোমাকে যাঁরা লেশমাত্র ভজনা করে তারাই গভীর বাক্য-দ্বারা সরস্বতীর সভারঞ্জনময়ী তরুণলীলালহরী প্রকাশ করতে পারে। আমি সেই কবিচিত্তকমলবনের কিরণলেখাটির পরিচয় পেয়েছি।

শ্রীশ। আমিও অল্পদিন হল একটু পরিচয় পেয়েছি, তার পর থেকে কবিত্ব আমার পক্ষে সহজ হয়ে এসেছে।

অক্ষয়ের প্রবেশ

অক্ষয়। (স্বগত) নাঃ, দুটি নবযুবকে মিলে আমাকে আর ঘরে তিষ্ঠতে দিলে না দেখছি। একটি তো গিয়ে চোরের মতো আমার ঘরের মধ্যে হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন– ধরা পড়ে ভালোরকম জবাবদিহি করতে পারলে না, শেষকালে আমাকে নিয়ে পড়ল। তার খানিক বাদেই দেখি দ্বিতীয় ব্যক্তিটি গিয়ে ঘরের বইগুলি নিয়ে উলটে-পালটে নিরীক্ষণ করছে। তফাত থেকে দেখেই পালিয়ে এসেছি। বেশ মনের মতো করে চিঠিখানি যে লিখব এরা তা আর দিলে না। আহা, চমৎকার জ্যোৎস্না হয়েছে।

শ্রীশ। এই-যে অক্ষয়বাবু!

অক্ষয়। ঐ রে! একটা ডাকাত ঘরের মধ্যে, আর-একটা ডাকাত গলির মোড়ে। হা প্রিয়ে, তোমার ধ্যান থেকে যারা আমার মনকে বিক্ষিপ্ত করছে তারা মেনকা উর্বশী রম্ভা হলে আমার কোনো খেদ ছিল না– মনের মতো ধ্যান-ভঙ্গও অক্ষয়ের অদৃষ্টে নেই– কলিকালে ইন্দ্রদেবের বয়স বেশি হয়ে বেরসিক হয়ে উঠেছে!

বিপিনের প্রবেশ

বিপিন। এই-যে অক্ষয়বাবু, আপনাকেই খুঁজছিলুম!

অক্ষয়। হায় হতভাগ্য, এমন রাত্রি কি আমাকে খোঁজ করে বেড়াবার জন্যই হয়েছিল?–

In such a night as this,

When the sweet wind did gently kiss the trees,

And they did make no noise, in such a night

Troilus methinks mounted the Troyan walls

and sighed his soul toward the Grecian tents,

Where Cressid lay that night.

শ্রীশ। In such a night আপনি কী করতে বেরিয়েছেন অক্ষয়বাবু?

রসিক।

অপসরতি ন চক্ষুষো মৃগাক্ষী

রজনিরিয়ং চ ন যাতি নৈতি নিদ্রা।

চক্ষু’পরে মৃগাক্ষীর চিত্রখানি ভাসে–

রজনীও নাহি যায়, নিদ্রাও না আসে।

অক্ষয়বাবুর অবস্থা আমি জানি মশায়!

অক্ষয়। তুমি কে হে?

রসিক। আমি রসিকচন্দ্র– দুই দিকে দুই যুবককে আশ্রয় করে যৌবনসাগরে ভাসমান।

অক্ষয়। এ বয়সে যৌবন সহ্য হবে না রসিকদাদা!

রসিক। যৌবনটা কোন্‌ বয়সে যে সহ্য হয় তা তো জানি নে, ওটা অসহ্য ব্যাপার। শ্রীশবাবু, আপনার কিরকম বোধ হচ্ছে।

শ্রীশ। এখনো সম্পূর্ণ বোধ করতে পারি নি।

রসিক। আমার মতো পরিণত বয়সের জন্যে অপেক্ষা করছেন বুঝি? অক্ষয়দা, আজ তোমাকে বড়ো অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে।

অক্ষয়। তুমি তো অন্যমনস্ক দেখবেই, মনটা ঠিক তোমার দিকে নেই।– বিপিনবাবু, তুমি আমাকে খুঁজছিলে বললে বটে, কিন্তু খুব যে জরুরি দরকার আছে বলে বোধ হচ্ছে না, অতএব আমি এখন বিদায় হই– একটু বিশেষ কাজ আছে।

[প্রস্থান

রসিক। বিরহী চিঠি লিখতে চলল।

শ্রীশ। অক্ষয়বাবু আছেন বেশ।– রসিকবাবু, ওঁর স্ত্রীই বুঝি বড়ো বোন? তাঁর নাম?

রসিক। পুরবালা।

বিপিন। (নিকটে আসিয়া) কী নাম বললেন?

রসিক। পুরবালা।

বিপিন। তিনিই বুঝি সব চেয়ে বড়ো?

রসিক। হাঁ।

বিপিন। সব ছোটোটির নাম?

রসিক। নীরবালা।

শ্রীশ। আর, নৃপবালা কোন্‌টি?

রসিক। তিনি নীরবালার বড়ো।

শ্রীশ। তা হলে নৃপবালাই হলেন মেজো।

বিপিন। আর নীরবালা ছোটো।

শ্রীশ। পুরবালার ছোটো নৃপবালা।

বিপিন। তাঁর ছোটো হচ্ছেন নীরবালা।

রসিক। (স্বগত) এরা তো নাম জপ করতে শুরু করলে। আমার মুশকিল। আর তো হিম সহ্য হবে না, পালাবার উপায় করা যাক।

বনমালীর প্রবেশ

বনমালী। এই-যে, আপনারা এখানে! আমি আপনাদের বাড়ি গিয়েছিলুম।

শ্রীশ। এইবার আপনি এখানে থাকুন, আমরা বাড়ি যাই।

বনমালী। আপনারা সর্বদাই ব্যস্ত দেখতে পাই।

বিপিন। তা, আপনি আমাদের কখনো সুস্থ দেখেন নি– একটু বিশেষ ব্যস্ত হয়েই পড়ি।

বনমালী। পাঁচ মিনিট যদি দাঁড়ান।

শ্রীশ। রসিকবাবু, একটু ঠাণ্ডা বোধ হচ্ছে না?

রসিক। আপনাদের এতক্ষণে বোধ হল, আমার অনেকক্ষণ থেকেই বোধ হচ্ছে।

বনমালী। চলুন-না, ঘরেই চলুন-না!

শ্রীশ। মশায়, এত রাত্রে যদি আমার ঘরে ঢোকেন তা হলে কিন্তু–

বনমালী। যে আজ্ঞে, আপনারা কিছু ব্যস্ত আছেন দেখছি, তা হলে আর-এক সময় হবে।

একাদশ পরিচ্ছেদ

রসিক। ভাই শৈল!

শৈল। কী রসিকদাদা!

রসিক। এ কি আমার কাজ? মহাদেবের তপোভঙ্গের জন্যে স্বয়ং কন্দর্পদেব ছিলেন, আর আমি বৃদ্ধ–

শৈল। তুমি তো বৃদ্ধ, তেমনি যুবক দুটিও তো যুগল মহাদেব নন!

রসিক। তা নন, সে আমি বেশ ঠাহর করেই দেখেছি। সেইজন্যই তো নির্ভয়ে এসেছিলুম। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে রাস্তার মধ্যে হিমে দাঁড়িয়ে অর্ধেক রাত পর্যন্ত রসালাপ করবার মতো উত্তাপ আমার শরীরে তো নেই!

শৈল। তাঁদের সংসর্গে উত্তাপ সঞ্চয় করে নেবে।

0 Shares