রসিক। সজীব গাছ যে সূর্যের তাপে প্রফুল্ল হয়ে ওঠে, মরা কাঠ তাতেই ফেটে যায়– যৌবনের উত্তাপ বুড়োমানুষের পক্ষে ঠিক উপযোগী বোধ হয় না।
শৈল। কই, তোমাকে দেখে ফেটে যাবে বলে তো বোধ হচ্ছে না।
রসিক। হৃদয়টা দেখলে বুঝতে পারতিস ভাই!
শৈল। কী বল রসিকদা! তোমারই তো এখন সব চেয়ে নিরাপদ বয়েস। যৌবনের দাহে তোমার কী করবে?
রসিক। শুষ্কেন্ধনে বহ্নিরুপৈতি বৃদ্ধিম্। যৌবনের দাহ বৃদ্ধকে পেলেই হুহুঃ শব্দে জ্বলে ওঠে– সেইজন্যেই তো “বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা’ বিপত্তির কারণ! কী আর বলব ভাই!
নীরবালার প্রবেশ
রসিক। আগচ্ছ বরদে দেবি! কিন্তু, বর তুমি আমাকে দেবে কি না জানি নে, আমি তোমাকে একটি বর দেবার জন্যে প্রাণপাত করে মরছি। শিব তো কিছুই করছেন না, তবু তোমাদের পুজো পাচ্ছেন; আর এই-যে বুড়ো খেটে মরছে, এ কি কিছুই পাবে না?
নীরবালা। শিব পান ফুল, তুমি পাবে তার ফল– তোমাকেই বরমাল্য দেব রসিকদাদা!
রসিক। মাটির দেবতাকে নৈবেদ্য দেবার সুবিধা এই যে, সেটি সম্পূর্ণ ফিরে পাওয়া যায়– আমাকেও নির্ভয়ে বরমাল্য দিতে পারিস, যখনই দরকার হবে তখনই ফিরে পাবি– তার চেয়ে, ভাই, আমাকে একটা গলাবন্ধ বুনে দিস, বরমাল্যের চেয়ে সেটা বুড়োমানুষের কাজে লাগবে।
নীরবালা। তা দেব– একজোড়া পশমের জুতো বুনে রেখেছি, সেই শ্রীচরণেষু হবে।
রসিক। আহা, কৃতজ্ঞতা একেই বলে। কিন্তু, নীরু, আমার পক্ষে গলাবন্ধই যথেষ্ট– আপাদমস্তক নাই হল। সেজন্যে উপযুক্ত লোক পাওয়া যাবে, জুতোটা তাঁরই জন্যে রেখে দে।
নীরবালা। আচ্ছা, তোমার বক্তৃতাও তুমি রেখে দাও।
রসিক। দেখেছিস ভাই শৈল, আজকাল নীরুরও লজ্জা দেখা দিয়েছে– লক্ষণ খারাপ।
শৈল। নীরু, তুই করছিস কী! আবার এ ঘরে এসেছিস! আজ যে এখানে আমাদের সভা বসবে– এখনই কে এসে পড়বে, বিপদে পড়বি।
রসিক। সেই বিপদের স্বাদ ও একবার পেয়েছে, এখন বারবার বিপদে পড়বার জন্যে ছট্ফট্ করে বেড়াচ্ছে।
নীরবালা। দেখো রসিকদাদা, তুমি যদি আমাকে বিরক্ত কর তা হলে গলাবদ্ধ পাবে না বলছি। দেখো দেখি দিদি, তুমিও যদি রসিকদার কথায় ঐরকম করে হাস তা হলে ওঁর আস্পর্ধা আরো বেড়ে যায়।
রসিক। দেখেছিস ভাই শৈল, নীরু আজকাল ঠাট্টাও সইতে পারছে না, মন এত দুর্বল হয়ে পড়েছে। নীরুদিদি, কোনো কোনো সময় কোকিলের ডাক শ্রুতিকটু বলে ঠেকে এইরকম শাস্ত্রে আছে, তোর রসিকদাদার ঠাট্টাকেও কি তোর আজকাল কুহুতান বলে ভ্রম হতে লাগল?
নীরবালা। সেইজন্যেই তো তোমার গলায় গলাবদ্ধ জড়িয়ে দিতে চাচ্ছি– তানটা যদি একটু কমে।
শৈল। নীরু, আর ঝগড়া করিস নে– আয়, এখনই সবাই এসে পড়বে।
[উভয়ের প্রস্থান
পূর্ণর প্রবেশ
রসিক। আসুন পূর্ণবাবু–
পূর্ণ। এখনো আর কেউ আসেন নি?
রসিক। আপনি বুঝি কেবল এই বৃদ্ধটিকে দেখে হতাশ হয়ে পড়েছেন। আরো সকলে আসবেন পূর্ণবাবু!
পূর্ণ। হতাশ কেন হব রসিকবাবু?
রসিক। তা কেমন করে বলব বলুন। কিন্তু ঘরে যেই ঢুকলেন আপনার দুটি চক্ষু দেখে বোধ হল তারা যাকে ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে সে ব্যক্তি আমি নই।
পূর্ণ। চক্ষুতত্ত্বে আপনার এতদূর অধিকার হল কী করে?
রসিক। আমার পানে কেউ কোনোদিন তাকায় নি পূর্ণবাবু, তাই এই প্রাচীন বয়স পর্যন্ত পরের চক্ষু পর্যবেক্ষণের যথেষ্ট অবসর পেয়েছি। আপনাদের মতো শুভাদৃষ্ট হলে দৃষ্টিতত্ত্ব লাভ না করে অনেক দৃষ্টি লাভ করতে পারতুম। কিন্তু যাই বলুন পূর্ণবাবু, চোখ দুটির মতো এমন আশ্চর্য সৃষ্টি আর কিছু হয় নি– শরীরের মধ্যে মন যদি কোথাও প্রত্যক্ষ বাস করে সে ঐ চোখের উপরে।
পূর্ণ। (সোৎসাহে) ঠিক বলেছেন রসিকবাবু! ক্ষুদ্র শরীরের মধ্যে যদি কোথাও অনন্ত আকাশ কিম্বা অনন্ত সমুদ্রের তুলনা থাকে সে ঐ দুটি চোখে।
রসিক।
নিঃসীমশোভাসৌভাগ্যং নতাঙ্গ্যা নয়নদ্বয়ং
অন্যোহন্যালোকনানন্দবিরহাদিব চঞ্চলং–
বুঝেছেন পূর্ণবাবু?
পূর্ণ। না, কিন্তু বোঝবার ইচ্ছা আছে।
রসিক।
আনতাঙ্গী বালিকার শোভাসৌভাগ্যের সার নয়নযুগল
না দেখিয়া পরস্পরে তাই কি বিরহভরে হয়েছে চঞ্চল?
পূর্ণ। না রসিকবাবু, ও ঠিক হল না। ও কেবল বাক্চাতুরী। দুটো চোখ পরস্পরকে দেখতে চায় না।
রসিক। অন্য দুটো চোখকে দেখতে চায় তো? সেইরকম অর্থ করেই নিন-না! শেষ দুটো ছত্র বদলে দেওয়া যাক–
প্রিয়চক্ষু-দেখাদেখি যে আনন্দ তাই সে কি খুঁজিছে চঞ্চল?
পূর্ণ। চমৎকার হয়েছে রসিকবাবু!
প্রিয়চক্ষু-দেখাদেখি যে আনন্দ তাই সে কি খুঁজিছে চঞ্চল?
অথচ সে বেচারা বন্দী খাঁচার পাখির মতো কেবল এ পাশে ও পাশে ছট্ফট্ করে– প্রিয়চক্ষু যেখানে, সেখানে পাখা মেলে উড়ে যেতে পারে না।
রসিক। আবার দেখাদেখির ব্যাপারখানাও যে কিরকম নিদারুণ তাও শাস্ত্রে লিখেছে–
হত্বা লোচনবিশিখৈর্গত্বা কতিচিৎ পদানি পদ্মাক্ষী
জীবতি যুবা ন বা কিং ভূয়ো ভূয়ো বিলোকয়তি।
বিঁধিয়া দিয়া আঁখিবাণে
যায় সে চলি গৃহপানে,
জনমে অনুশোচনা–
বাঁচিল কি না দেখিবারে
চায় সে ফিরে বারে বারে
কমলবরলোচনা!
পূর্ণ। রসিকবাবু, বারে বারে ফিরে চায় কেবল কাব্যে।
রসিক। তার কারণ, কাব্যে ফিরে চাবার কোনো অসুবিধে নেই। সংসারটা যদি ঐরকম ছন্দে তৈরি হত তা হলে এখানেও ফিরে ফিরে চাইত পূর্ণবাবু– এখানে মন ফিরে চায়, চক্ষু ফেরে না।