প্রজাপতির নির্বন্ধ

অক্ষয়। তুমি অনেক কৌশলে তোমার পসার বাঁচিয়ে রেখেছ, তার মধ্যে তোমার এই টাক একটি।

রসিক। আর একটি হচ্ছে– যাবৎ কিঞ্চিন্ন ভাষতে। তা, আমি বাইরের লোকের কাছে বেশি কথা কই নে–

শৈল। সেইটে বুঝি আমাদের কাছে পুষিয়ে নাও।

রসিক। তোদের কাছে যে ধরা পড়েছি।

শৈল। ধরা যদি পড়ে থাক তো চলো– যা বলি তাই করতে হবে।

বলিয়া পরামর্শের জন্য শৈল তাঁহাকে অন্য ঘরে টানিয়া লইয়া চলিল।

অক্ষয় বলিতে লাগিল, “অ্যাঁ, শৈল! এই বুঝি! আজ রসিকদা হলেন রাজমন্ত্রী। আমাকে ফাঁকি!”

শৈল যাইতে যাইতে পশ্চাৎ ফিরিয়া হাসিয়া কহিল, “তোমার সঙ্গে আমার কি পরামর্শের সম্পর্ক মুখুজ্যেমশায়? পরামর্শ যে বুড়ো না হলে হয় না।”

অক্ষয় বলিল, “তবে রাজমন্ত্রী-পদের জন্যে আমার দরবার উঠিয়ে নিলুম।” বলিয়া শূন্য ঘরের মধ্যে দাঁড়াইয়া হঠাৎ উচ্চৈঃস্বরে খাম্বাজে গান ধরিলেন–

আমি কেবল ফুল জোগাব

তোমার দুটি রাঙা হাতে,

বুদ্ধি আমার খেলে নাকো

পাহারা বা মন্ত্রণাতে।

বাড়ির কর্তা যখন বাঁচিয়া ছিলেন তিনি রসিককে খুড়া বলিতেন। রসিক দীর্ঘকাল হইতে তাঁহার আশ্রয়ে থাকিয়া বাড়ির সুখদুঃখে সম্পূর্ণ জড়িত হইয়া ছিলেন। গিন্নি অগোছালো থাকাতে কর্তার অবর্তমানে তাঁহার কিছু অযত্ন-অসুবিধা হইতেছিল এবং জগত্তারিণীর অসংগত ফরমাশ খাটিয়া তাঁহার অবকাশের অভাব ঘটিয়াছিল। কিন্তু তাঁহার এই-সমস্ত অভাব-অসুবিধা পূরণ করিবার লোক ছিল শৈল। শৈল থাকাতেই মাঝে মাঝে ব্যামোর সময় তাঁহার পথ্য এবং সেবার ত্রুটি হইতে পারে নাই; এবং তাহারই সহকারিতায় তাঁহার সংস্কৃতসাহিত্যের চর্চা পুরাদমেই চলিয়াছিল।

রসিকদা শৈলবালার অদ্ভুত প্রস্তাব শুনিয়া প্রথমটা হাঁ করিয়া রহিলেন, তাহার পর হাসিতে লাগিলেন, তাহার পর রাজি হইয়া গেলেন। কহিলেন, “ভগবান হরি নারী-ছদ্মবেশে পুরুষকে ভুলিয়েছিলেন, তুই শৈল যদি পুরুষ-ছদ্মবেশে পুরুষকে ভোলাতে পারিস তা হলে হরিভক্তি উড়িয়ে দিয়ে তোর পুজোতেই শেষ বয়সটা কাটাব। কিন্তু মা যদি টের পান?”

শৈল। তিন কন্যাকে কেবলমাত্র স্মরণ করেই মা মনে মনে এত অস্থির হয়ে ওঠেন যে, তিনি আমাদের আর খবর রাখতে পারেন না। তাঁর জন্যে ভেবো না।

রসিক। কিন্তু সভায় কিরকম করে সভ্যতা করতে হয়, সে আমি কিছুই জানি নে।

শৈল। আচ্ছা সে আমি চালিয়ে নেব।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

শ্রীশ ও বিপিন

শ্রীশ। তা যাই বল, অক্ষয়বাবু যখন আমাদের সভাপতি ছিলেন তখন আমাদের চিরকুমার-সভা জমেছিল ভালো। হাল সভাপতি চন্দ্রবাবু কিছু কড়া।

বিপিন। তিনি থাকতে রস কিছু বেশি জমে উঠেছিল। চিরকৌমার্যব্রতের পক্ষে রসাধিক্যটা ভালো নয় আমার তো এই মত।

শ্রীশ। আমার মত ঠিক উল্‌টো। আমাদের ব্রত কঠিন বলেই রসের দরকার বেশি। রুক্ষ মাটিতে ফসল ফলাতে গেলে কি জলসিঞ্চনের প্রয়োজন হয় না? চিরজীবন বিবাহ করব না এই প্রতিজ্ঞাই যথেষ্ট, তাই বলেই কি সব দিক থেকেই শুকিয়ে মরতে হবে?

বিপিন। যাই বল, হঠাৎ কুমারসভা ছেড়ে দিয়ে বিবাহ করে অক্ষয়বাবু আমাদের সভাটাকে যেন আলগা করে দিয়ে গেছেন। ভিতরে ভিতরে আমাদের সকলেরই প্রতিজ্ঞার জোর কমে গেছে।

শ্রীশ। কিছুমাত্র না। আমার নিজের কথা বলতে পারি, আমার প্রতিজ্ঞার বল আরো বেড়েছে। যে ব্রত সকলে অনায়াসেই রক্ষা করতে পারে তার উপরে শ্রদ্ধা থাকে না।

বিপিন। একটা সুখবর দিই শোনো।

শ্রীশ। তোমার বিবাহের সম্বন্ধ হয়েছে না কি?

বিপিন। হয়েছে বৈকি, তোমার দৌহিত্রীর সঙ্গে। ঠাট্টা রাখো, পূর্ণ কাল কুমারসভার সভ্য হয়েছে।

শ্রীশ। পূর্ণ! বল কী! তা হলে তো শিলা জলে ভাসল!

বিপিন। শিলা আপনি ভাসে না হে! তাকে আর- কিছুতে অকূলে ভাসিয়েছে। আমার যথাবুদ্ধি তার ইতিহাসটুকু সংকলন করেছি।

শ্রীশ। তোমার বুদ্ধির দৌড়টা কিরকম শুনি।

বিপিন। জানই তো, পূর্ণ সন্ধ্যাবেলায় চন্দ্রবাবুর কাছে পড়ার নোট নিতে যায়। সেদিন আমি আর পূর্ণ একসঙ্গেই একটু সকাল-সকাল চন্দ্রবাবুর বাসায় গিয়েছিলেম। তিনি একটা মিটিং থেকে সবে এসেছেন। বেহারা কেরোসিন জ্বেলে দিয়ে গেছে– পূর্ণ বইয়ের পাত ওলটাচ্ছে, এমন সময়– কী আর বলব ভাই, সে বঙ্কিমবাবুর নভেল বিশেষ– একটি কন্যা পিঠে বেণী দুলিয়ে–

শ্রীশ। বল কী হে বিপিন!

বিপিন। শোনোই-না। এক হাতে থালায় করে চন্দ্রবাবুর জন্যে জলখাবার আর-এক হাতে জলের গ্লাস নিয়ে হঠাৎ ঘরের মধ্যে এসে উপস্থিত। আমাদের দেখেই তো কুন্ঠিত, সচকিত, লজ্জায় মুখ রক্তিমবর্ণ। হাত জোড়া, মাথায় কাপড় দেবার জো নেই। তাড়াতাড়ি টেবিলের উপর খাবার রেখেই ছুট। ব্রাহ্ম বটে, কিন্তু তেত্রিশ কোটির সঙ্গে লজ্জাকে বিসর্জন দেয় নি এবং সত্য বলছি শ্রীকেও রক্ষা করেছে।

শ্রীশ। বল কী বিপিন, দেখতে ভালো বুঝি?

বিপিন। দিব্যি দেখতে। হঠাৎ যেন বিদ্যুতের মতো এসে পড়ে পড়াশুনোয় বজ্রাঘাত করে গেল।

শ্রীশ। আহা, কই, আমি তো একদিনও দেখি নি! মেয়েটি কে হে!

বিপিন। আমাদের সভাপতির ভাগ্নী, নাম নির্মলা।

শ্রীশ। কুমারী?

বিপিন। কুমারী বৈকি। তার ঠিক পরেই পূর্ণ হঠাৎ আমাদের কুমারসভায় নাম লিখিয়েছে।

শ্রীশ। পূজারি সেজে ঠাকুর চুরি করবার মতলব?

একটি প্রৌঢ় ব্যক্তির প্রবেশ

0 Shares