শ্রীশ। (নিকটে আসিয়া) বিপিন, তুমি চন্দ্রবাবুর কাছে একবার যাও। বাস্তবিক, আমাদের কর্তব্যে আমরা ঢিলে দিয়েছি– ওঁর সঙ্গে একটু আলোচনা করলে উনি খুশি হবেন!
বিপিন। আচ্ছা।
[প্রস্থান
শ্রীশ। হাঁ, আপনি সেই যে সেলাইয়ের কথা বলছিলেন– উনি বুঝি নিজের হাতে সমস্ত গৃহকর্ম করেন?
রসিক। সমস্তই।
শ্রীশ। আপনি বুঝি সেদিন গিয়ে দেখলেন তাঁর কোলে বালিশের ওয়াড়গুলো পড়ে রয়েছে, আর তিনি–
রসিক। মাথা নিচু করে ছুঁচে সুতো পরাচ্ছিলেন।
শ্রীশ। ছুঁচে সুতো পরাচ্ছিলেন! তখন স্নান করে এসেছেন বুঝি?
রসিক। বেলা তখন তিনটে হবে।
শ্রীশ। বেলা তিনটে– তিনি বুঝি তাঁর খাটের উপর বসে–
রসিক। না, খাটে নয়, বারান্দার উপর মাদুর বিছিয়ে–
শ্রীশ। বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে বসে ছুঁচে সুতো পরাচ্ছিলেন–
রসিক। হাঁ, ছুঁচে সুতো পরাচ্ছিলেন। (স্বগত) আর তো পারা যায় না।
শ্রীশ। আমি যেন ছবির মতো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি– পা দুটি ছড়ানো, মাথা নিচু, খোলা চুল মুখের উপর এসে পড়েছে– বিকেলবেলার আলো–
বিপিন। (নিকটে আসিয়া) চন্দ্রবাবু তোমার সঙ্গে তোমার সেই প্রবন্ধটা সম্বন্ধে কথা কইতে চান। (শ্রীশের প্রস্থান) রসিকবাবু–
রসিক। (স্বগত) আর কত বকব?
অন্য প্রান্তে
নির্মলা। (পূর্ণের প্রতি) আপনার শরীর আজ বুঝি তেমন ভালো নেই।
পূর্ণ। না, বেশ আছে– হাঁ, একটু ইয়ে হয়েছে বটে– বিশেষ কিছু নয়– তবু একটু ইয়ে বৈকি– তেমন বেশ– (কাসি) আপনার শরীর বেশ ভালো আছে?
নির্মলা। হাঁ।
পূর্ণ। আপনি– জিজ্ঞাসা করছিলুম যে আপনি– আপনি– আপনার ইয়ে কী রকম বোধ হয়– ঐ-যে– মিল্টনের আরিয়োপ্যাজিটিকা– ওটা কিনা আমাদের এম| এ| কোর্সে আছে, ওটা আপনার বেশ ইয়ে বোধ হয় না?
নির্মলা। আমি ওটা পড়ি নি।
পূর্ণ। পড়েন নি? (নিস্তব্ধ) ইয়ে হয়েছে– আপনি– এবারে কিরকম গরম পড়েছে– আমি একবার রসিকবাবু– রসিকবাবুর সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে।
[নির্মলার নিকট হইতে প্রস্থান
ঘরের অন্যত্র
বিপিন। রসিকবাবু, আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়, ও গানটা তিনি বিশেষ কিছু মনে করে লিখেছেন?
রসিক। হতেও পারে। আপনি আমাকে সুদ্ধ ধোঁকা লাগিয়ে দিলেন যে! পূর্বে ওটা ভাবি নি।
বিপিন।
তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়
কোন্ পাথারে কোন্ পাষাণের ঘায়।
আচ্ছা রসিকবাবু, এখানে তরী বলতে ঠিক কী বোঝাচ্ছে?
রসিক। হৃদয় বোঝাচ্ছে তার আর সন্দেহ নেই। তবে ঐ পাথারটা কোথায় আর পাষাণটা কে সেইটেই ভাববার বিষয়।
পূর্ণ। (নিকট আসিয়া) বিপিনবাবু, মাপ করবেন– রসিকবাবুর সঙ্গে আমার একটি কথা আছে– যদি–
বিপিন। বেশ, বলুন, আমি যাচ্ছি।
[প্রস্থান
পূর্ণ। আমার মতো নির্বোধ জগতে নেই রসিকবাবু!
রসিক। আপনার চেয়ে ঢের নির্বোধ আছে যারা নিজেকে বুদ্ধিমান বলে জানে– যথা আমি।
পূর্ণ। একটু নিরালা পাই যদি, আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে, সভা ভেঙে গেলে আজ রাত্রে একটু অবসর করতে পারেন?
রসিক। বেশ কথা।
পূর্ণ। আজ দিব্য জ্যোৎস্না আছে, গোলদিঘির ধারে– কী বলেন?
রসিক। (স্বগত) কী সর্বনাশ!
শ্রীশ। (নিকটে আসিয়া) ওঃ, পূর্ণবাবু কথা কচ্ছেন বুঝি। আচ্ছা, এখন থাক্। রাত্রে আপনার অবসর হবে রসিকবাবু?
রসিক। তা হতে পারে।
শ্রীশ। তা হলে কালকের মতো– কী বলেন? কাল দেখলেন তো ঘরের চেয়ে পথে জমে ভালো।
রসিক। জমে বৈকি! (স্বগত) সর্দি জমে, কাসি জমে, গলার স্বর দইয়ের মতো জমে যায়।
[শ্রীশের প্রস্থান
পূর্ণ। আচ্ছা রসিকবাবু, আপনি হলে কী বলে কথা আরম্ভ করতেন?
রসিক। হয়তো বলতুম– সেদিন বেলুন উড়েছিল, আপনাদের বাড়ির ছাত থেকে দেখতে পেয়েছিলেন কি?
পূর্ণ। তিনি যদি বলতেন, হাঁ–
রসিক। আমি বলতুম, মনকে ওড়বার অধিকার দিয়েছেন বলেই ঈশ্বর মানুষের শরীরে পাখা দেন নি– শরীরকে বদ্ধ রেখে বিধাতা মনের আগ্রহ কেবল বাড়িয়ে দিয়েছেন–
পূর্ণ। বুঝেছি রসিকবাবু– চমৎকার– এর থেকে অনেক কথার সৃষ্টি হতে পারে।
বিপিন। (নিকটে আসিয়া) পূর্ণবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছে। থাক্ তবে। আমাদের সেই-যে একটা কথা ছিল সেটা আজ রাত্রে হবে, কী বলেন?
রসিক। সেই ভালো।
বিপিন। জ্যোৎস্নায় রাস্তায় বেড়াতে বেড়াতে দিব্যি আরামে– কী বলেন?
রসিক। খুব আরাম। (স্বগত) কিন্তু বেয়ারামটা তার পরে।
অন্যত্র
শৈল। (নির্মলার প্রতি) তা বেশ, আপনি যদি ইচ্ছা করেন আমিও ঐ বিষয়টার আলোচনা করে দেখব। ডাক্তারি আমি অল্প অল্প চর্চা করেছি, বেশি নয়, কিন্তু আমি যোগদান করলে আপনার যদি উৎসাহ হয় আমি প্রস্তুত আছি।
পূর্ণ। (নিকটে আসিয়া) সেদিন বেলুন উড়েছিল, আপনি কি ছাদের উপর থেকে দেখতে পেয়েছিলেন?
নির্মলা। বেলুন?
পূর্ণ। হাঁ, ঐ বেলুন। (সকলে নিরুত্তর) রসিকবাবু বলছিলেন আপনি বোধ হয় দেখে থাকবেন– আমাকে মাপ করবেন– আপনাদের আলোচনায় আমি ভঙ্গ দিলুম– আমি অত্যন্ত হতভাগ্য।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
পূর্বদিনে পূরবালা তাহার মাতার সহিত কাশী হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে। অক্ষয় কহিলেন, “দেবী, যদি অভয় দাও তো একটি প্রশ্ন আছে।”
পুরবালা। কী শুনি।
অক্ষয়। শ্রীঅঙ্গে কৃশতায় তো কোনো লক্ষণ দেখছি নে।
পুরবালা। শ্রীঅঙ্গ তো কৃশ হবার জন্যে পশ্চিমে বেড়াতে যায় নি।
অক্ষয়। তবে কি বিরহবেদনা বলে জিনিসটা মহাকবি কালিদাসের সঙ্গে সহমরণে মরেছে?