প্রজাপতির নির্বন্ধ

শ্রীশ। বিপিন, তোমার সঙ্গে–

বিপিন। না ভাই, আমার সঙ্গে তর্ক কোরো না, আমি হারলুম– কিন্তু বইটা রাখো।

রসিকের প্রবেশ

রসিক। এই-যে আপনারা এসে একলা বসে আছেন, কিছু মনে করবেন না–

শ্রীশ। কিছু না। এই ঘরটি আমাদের সাদর সম্ভাষণ করে নিয়েছিল।

রসিক। আপনাদের কত কষ্টই দেওয়া গেল!

শ্রীশ। কষ্ট আর দিতে পারলেন কই? একটা কষ্টের মতো কষ্ট স্বীকার করবার সুযোগ পেলে কৃতার্থ হতুম।

রসিক। যা হোক, অল্পক্ষণের মধ্যেই চুকে যাবে এই এক সুবিধে, তার পরেই আপনারা স্বাধীন। ভেবে দেখুন দেখি যদি এটা সত্যকার ব্যাপার হত তা হলেই পরিণামে বন্ধনভয়ং! বিবাহ জিনিসটা মিষ্টান্ন দিয়েই শুরু হয়, কিন্তু সকল সময় মধুরেণ সমাপ্ত হয় না। আচ্ছা, আজ আপনারা দুঃখিতভাবে এরকম চুপচাপ করে বসে আছেন কেন বলুন দেখি। আমি বলছি আপনাদের কোনো ভয় নেই। আপনারা বনের বিহঙ্গ, দুটিখানি সন্দেশ খেয়েই আবার বনে উড়ে যাবেন, কেউ আপনাদের বাঁধবে না। নাত্র ব্যাধশরাঃ পতন্তি পরিতো নৈবাত্র দাবানলঃ। দাবানলের পরিবর্তে ডাবের জল পাবেন।

শ্রীশ। আমাদের সে দুঃখ নয় রসিকবাবু, আমরা ভাবছি আমাদের দ্বারা কতটুকু উপকারই বা হচ্ছে। ভবিষ্যতের সমস্ত আশঙ্কা তো দূর করতে পারছি নে।

রসিক। বিলক্ষণ! যা করছেন তাতে আপনারা দুটি অবলাকে চিরকৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ করছেন– অথচ নিজেরা কোনোপ্রকার পাশেই বদ্ধ হচ্ছেন না।

জগত্তারিণী। (নেপথ্যে মৃদুস্বরে) আঃ নেপ, কী ছেলেমানুষি করছিস! শিগ্‌গির চোখের জল মুছে ঘরের মধ্যে যা! লক্ষ্মী মা আমার– কেঁদে চোখ লাল করলে কিরকম ছিরি হবে ভেবে দেখ্‌ দেখি!– নীর, যা-না! তোদের সঙ্গে আর পারি নে বাপু! ভদ্রলোকদের কতক্ষণ বসিয়ে রাখবি? কী মনে করবেন?

শ্রীশ। ঐ শুনছেন রসিকবাবু? এ অসহ্য! এর চেয়ে রাজপুতদের কন্যাহত্যা ভালো।

বিপিন। রসিকবাবু, এঁদের এই সংকট থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা করবার জন্যে আপনি আমাদের যা বলবেন আমরা তাতেই প্রস্তুত আছি।

রসিক। কিছু না, আপনাদের আর অধিক কষ্ট দেব না! কেবল আজকের দিনটা উত্তীর্ণ করে দিয়ে যান– তার পরে আপনাদের আর কিছুই ভাবতে হবে না।

শ্রীশ। ভাবতে হবে না? কী বলেন রসিকবাবু! আমরা কি পাষাণ? আজ থেকেই আমরা বিশেষরূপে এঁদের জন্য ভাববার অধিকার পাব।

বিপিন। এমন ঘটনার পর আমরা যদি এঁদের সম্বন্ধে উদাসীন হই তবে আমরা কাপুরুষ।

শ্রীশ। এখন থেকে এঁদের জন্যে ভাবা আমাদের পক্ষে গর্বের বিষয়– গৌরবের বিষয়।

রসিক। তা বেশ, ভাববেন, কিন্তু বোধ হয় ভাবা ছাড়া আর কোনো কষ্ট করতে হবে না।

শ্রীশ। আচ্ছা রসিকবাবু, আমাদের কষ্ট স্বীকার করতে দিতে আপনার এত আপত্তি হচ্ছে কেন?

বিপিন। এঁদের জন্যে যদিই আমাদের কোনো কষ্ট করতে হয় সেটা যে আমরা সম্মান বলে জ্ঞান করব।

শ্রীশ। দু দিন ধরে, রসিকবাবু, বেশি কষ্ট পেতে হবে না বলে আপনি ক্রমাগতই আমাদের আশ্বাস দিচ্ছেন। এতে আমরা বাস্তবিক দুঃখিত হয়েছি।

রসিক। আমাকে মাপ করবেন– আমি আর কখনো এমন অবিবেচনার কাজ করব না, আপনারা কষ্ট স্বীকার করবেন!

শ্রীশ। আপনি কি এখনো আমাদের চিনলেন না?

রসিক। চিনেছি বৈকি, সেজন্যে আপনারা কিছুমাত্র চিন্তিত হবেন না।

কুণ্ঠিত নৃপবালা ও নীরবালার প্রবেশ

শ্রীশ। (নমস্কার করিয়া) রসিকবাবু, আপনি এঁদের বলুন আমাদের যেন মার্জনা করেন।

বিপিন। আমরা যদি ভ্রমেও ওঁদের লজ্জা বা ভয়ের কারণ হই তবে তার চেয়ে দুঃখের বিষয় আমাদের পক্ষে আর কিছুই হতে পারে না, সেজন্যে যদি ক্ষমা না করেন তবে–

রসিক। বিলক্ষণ! ক্ষমা চেয়ে অপরাধিনীদের আর অপরাধ বাড়াবেন না। এঁদের অল্প বয়স, মান্য অতিথিদের কিরকম সম্ভাষণ করা উচিত তা যদি এঁরা হঠাৎ ভুলে গিয়ে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকেন তা হলে আপনাদের প্রতি অসদ্ভাব কল্পনা করে এঁদের আরো লজ্জিত করবেন না। নৃপদিদি, নীরদিদি– কী বল ভাই! যদিও এখনো তোমাদের চোখের পাতা শুকোয় নি, তবু এঁদের প্রতি তোমাদের মন যে বিমুখ নয় সে কথা কি জানাতে পারি? (নৃপ ও নীর লজ্জিত-নিরুত্তর) না, একটু আড়ালে জিজ্ঞাসা করা দরকার। (জনান্তিকে) ভদ্রলোকদের এখন কী বলি বলো তো ভাই? বলব কি, তোমরা যত শীঘ্র পার বিদায় হও!

নীরবালা। (মৃদুস্বরে) রসিকদাদা, কী বকো তার ঠিক নেই, আমরা কি তাই বলেছি! আমরা কি জানতুম এঁরা এসেছেন?

রসিক। (শ্রীশ ও বিপিনের প্রতি) এঁরা বলছেন–

সখা, কী মোর করমে লেখি!

তপত বলিয়া তপনে ডরিনু,

চাঁদের কিরণ দেখি!

এর উপরে আপনাদের কিছু বলবার আছে?

নীরবালা। (জনান্তিকে) আঃ রসিকদাদা, কী বলছ তার ঠিক নেই! ও কথা আমরা কখন বললুম!

রসিক। (শ্রীশ ও বিপিনের প্রতি) এঁদের মনের ভাবটা আমি সম্পূর্ণ ব্যক্ত করতে পারি নি বলে এঁরা আমাকে ভর্ৎসনা করছেন। এঁরা বলতে চান, চাঁদের কিরণ বললেও যথেষ্ট বলা হয় না– তার চেয়ে আরো যদি–

নীরবালা। (জনান্তিকে) তুমি অমন কর যদি তা হলে আমরা চলে যাব।

রসিক। সখি, ন যুক্তম্‌ অকৃতসৎকারম্‌ অতিথিবিশেষম্‌ উজ্‌ঝিত্বা স্বচ্ছন্দতো গমনম্‌! (শ্রীশ ও বিপিনের প্রতি) এঁরা বলছেন এঁদের যথার্থ মনের ভাবটি যদি আপনাদের কাছে ব্যক্ত করে বলি, তা হলে এঁরা লজ্জায় এ ঘর থেকে চলে যাবেন।

[নৃপ ও নীরর প্রস্থানোদ্যম

0 Shares