প্রজাপতির নির্বন্ধ

অক্ষয় মৃদুস্বরে বলিলেন, “আজকের মতো এইটেই চলুক।”

দারুকেশ্বর কহিল, “সে কি হয় মশায়! আশা দিয়ে নৈরাশ! শ্বশুরবাড়ি এসে মটন চপ খেতে পাব না? আর এ যে বরফ-জল মশায়, আমার আবার সর্দির ধাত, সাদা জল সহ্য হয় না।” বলিয়া গান জুড়িয়া দিল, “অভয় দাও তো বলি আমার wish কী” ইত্যাদি। অক্ষয় মৃত্যুঞ্জয়কে কেবলই টিপিতে লাগিলেন এবং অস্পষ্ট স্বরে কহিতে লাগিলেন, “ধরো না হে, তুমিও ধরো না– চুপচাপ কেন।” সে ব্যক্তি কতক ভয়ে কতক লজ্জায় মৃদু মৃদু যোগ দিতে লাগিল। গানের উচ্ছ্বাস থামিলে অক্ষয় আহারপাত্র দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “নিতান্তই কি এটা চলবে না?”

দারুকেশ্বর ব্যস্ত হইয়া কহিল, “না মশায়, ও-সব রুগীর পথ্যি চলবে না! মুর্গি না খেয়েই তো ভারতবর্ষ গেল!” বলিয়া ফড়ফড় করিয়া গুড়গুড়ি টানিতে লাগিল।

অক্ষয় কানের কাছে আসিয়া লক্ষ্ণৌ ঠুংরিতে ধরাইয়া দিলেন–

কত কাল রবে বলো ভারত রে

শুধু ডাল ভাত জল পথ্য করে।

শুনিয়া দারুকেশ্বর উৎসাহ-সহকারে গানটা ধরিল এবং মৃত্যুঞ্জয়ও অক্ষয়ের গোপন ঠেলা খাইয়া সলজ্জভাবে মৃদু মৃদু যোগ দিতে লাগিল।

অক্ষয় আবার কানে কানে ধরাইয়া দিলেন–

দেশে অন্নজলের হল ঘোর অনটন,

ধরো হুইস্কি সোডা আর মুর্গিমটন।

অমনি দারুকেশ্বর মাতিয়া উঠিয়া ঊর্ধ্বস্বরে ঐ পদটা ধরিল এবং অক্ষয়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের প্রবল উৎসাহে মৃত্যুঞ্জয়ও কোনোমতে সঙ্গে সঙ্গে যোগ দিয়া গেল।

অক্ষয় পুনশ্চ ধরাইয়া দিলেন–

যাও ঠাকুর চৈতন চুটকি নিয়া,

এসো দাড়ি নাড়ি কলিমদ্দি মিঞা!

যতই উৎসাহসহকারে গান চলিল, দ্বারের পার্শ্ব হইতে উসখুস শব্দ শুনা যাইতে লাগিল এবং অক্ষয় নিরীহ ভালোমানুষটির মতো মাঝে মাঝে সেই দিকে কটাক্ষপাত করিতে লাগিলেন।

এমন সময় ময়লা ঝাড়ন হাতে কলিমদ্দি আসিয়া সেলাম করিয়া দাঁড়াইল। দারুকেশ্বর উৎসাহিত হইয়া কহিল, “এই-যে চাচা! আজ রান্নাটা কী হয়েছে বলো দেখি।”

সে অনেকগুলা ফর্দ দিয়া গেল। দারুকেশ্বর কহিল, “কোনোটাই তো মন্দ শোনাচ্ছে না হে। (অক্ষয়ের প্রতি) মশায়, কী বিবেচনা করেন? ওর মধ্যে বাদ দেবার কি কিছু আছে?”

অক্ষয় অন্তরালের দিকে কটাক্ষ করিয়া কহিলেন “সে আপনারা যা ভালো বোঝেন!”

দারুকেশ্বর কহিল, “আমার তো মত, ব্রাহ্মণেভ্যো নমঃ বলে সব-কটাকেই আদর করে নিই।”

অক্ষয়। তা তো বটেই, ওঁরা সকলেই পূজ্য।

কলিমদ্দি সেলাম করিয়া চলিয়া গেল। অক্ষয় কিঞ্চিৎ গলা চড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মশায়রা কি তা হলে আজ রাত্রেই ক্রিশ্চান হতে চান?”

খানার আশ্বাসে প্রফুল্লচিত্তে দারুকেশ্বর কহিল, “আমার তো কথাই আছে, শুভস্য শীঘ্রং। আজই ক্রিশ্চান হব, এখনই ক্রিশ্চান হব, ক্রিশ্চান হয়ে তবে অন্য কথা। মশায়, আর ঐ পুঁইশাক কলাইয়ের ডাল খেয়ে প্রাণ বাঁচে না। আনুন আপনার পাদ্রি ডেকে।” বলিয়া পুনশ্চ উচ্চস্বরে গান ধরিল–

যাও ঠাকুর চৈতন চুটকি নিয়া,

এসো দাড়ি নাড়ি কলিমদ্দি মিঞা!

চাকর আসিয়া অক্ষয়ের কানে কানে কহিল, “মাঠাকরুন একবার ডাকছেন।”

অক্ষয় উঠিয়া দ্বারের অন্তরালে গেলে জগত্তারিণী কহিলেন, “এ কী! কাণ্ডটা কী?”

অক্ষয় গম্ভীরমুখে কহিলেন, “মা, সে-সব পরে হবে, এখন ওরা হুইস্কি চাচ্ছে, কী করি? তোমার পায়ে মালিশ করবার জন্যে সেই-যে ব্রাণ্ডি এসেছিল, তার কি কিছু বাকি আছে?”

জগত্তারিণী হতবুদ্ধি হইয়া কহিলেন, “বল কী বাছা? ব্রাণ্ডি খেতে দেবে?”

অক্ষয় কহিলেন, “কী করব মা, শুনেইছ তো, ওর মধ্যে একটি ছেলে আছে যার জল খেলেই সর্দি হয়, মদ না খেলে আর-একটির মুখে কথাই বের হয় না।”

জগত্তারিণী কহিলেন, “ক্রিশ্চান হবার কথা কী বলছে ওরা?”

অক্ষয় কহিলেন, “ওরা বলছে হিঁদু হয়ে খাওয়া-দাওয়ার বড়ো অসুবিধে, পুঁইশাক কলাইয়ের ডাল খেয়ে ওদের অসুখ করে!”

জগত্তারিণী অবাক হইয়া কহিলেন, “তাই বলে কি ওদের আজ রাতেই মুর্গি খাইয়ে ক্রিশ্চান করবে নাকি?”

অক্ষয় কহিলেন, “তা, মা, ওরা যদি রাগ করে চলে যায় তা হলে দুটি পাত্র এখনই হাতছাড়া হবে। তাই ওরা যা বলছে তাই শুনতে হচ্ছে, আমাকে সুদ্ধ মদ ধরাবে দেখছি।”

পুরবালা কহিলেন, “বিদায় করো, বিদায় করো, এখনই বিদায় করো।”

জগত্তারিণী ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “বাবা, এখানে মুর্গি খাওয়া-টাওয়া হবে না, তুমি ওদের বিদায় করে দাও। আমার ঘাট হয়েছিল আমি রসিককাকাকে পাত্র সন্ধান করতে দিয়েছিলুম। তাঁর দ্বারা যদি কোনো কাজ পাওয়া যায়।”

রমণীগণের প্রস্থান। অক্ষয় ঘরে আসিয়া দেখেন, মৃত্যুঞ্জয় পলায়নের উপক্রম করিতেছে এবং দারুকেশ্বর হাত ধরিয়া তাহাকে টানাটানি করিয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেছে। অক্ষয়ের অবর্তমানে মৃত্যুঞ্জয় অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করিয়া সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিয়াছে। অক্ষয় ঘরে প্রবেশ করিবামাত্র মৃত্যুঞ্জয় রাগের স্বরে বলিয়া উঠিল, “না মশায়, আমি ক্রিশ্চান হতে পারব না, আমার বিয়ে করে কাজ নেই।”

অক্ষয় কহিলেন, “তা, মশায়, আপনাকে কে পায়ে ধরাধরি করছে।”

দারুকেশ্বর কহিল, “আমি রাজি আছি মশায়।”

অক্ষয় কহিলেন, “রাজি থাকেন তো গির্জায় যান-না মশায়। আমার সাত পুরুষে ক্রিশ্চান করা ব্যবসা নয়!”

দারুকেশ্বর কহিল, “ঐ-যে কোন্‌ বিশ্বাসের কথা বললেন–”

অক্ষয়। তিনি টেরিটির বাজারে থাকেন, তাঁর ঠিকানা লিখে দিচ্ছি।

0 Shares