পুরবালা। কী বলিস তার ঠিক নেই! মেয়েমানুষ আবার সভ্য হবে কী!
শৈল। আজকাল মেয়েরাও যে সভ্য হয়ে উঠেছে| তাই আমি শাড়ি ছেড়ে চাপকান ধরব ঠিক করেছি।
পুরবালা। বুঝেছি, ছদ্মবেশে সভ্য হতে যাচ্ছিস বুঝি। চুলটা তো কেটেইছিস, ঐটেই বাকি ছিল। তোমাদের যা খুশি করো, আমি এর মধ্যে নেই।
অক্ষয়। না না, তুমি এ দলে ভিড়ো না! আর যার খুশি পুরুষ হোক, আমার অদৃষ্টে তুমি চিরদিন মেয়েই থেকো– নইলে ব্রীচ অফ কন্ট্রাক্ট্– সে বড়ো ভয়ানক মকদ্দমা!– বলিয়া সিন্ধুতে গান ধরিলেন–
চির-পুরানো চাঁদ!
চিরদিবস এমনি থেকো আমার এই সাধ।
পুরানো হাসি পুরানো সুধা, মিটায় মম পুরানো ক্ষুধা–
নূতন কোনো চকোর যেন পায় না পরসাদ!
পুরবালা রাগ করিয়া চলিয়া গেল। অক্ষয় শৈলবালাকে আশ্বাস দিয়া কহিলেন, “ভয় নেই। রাগটা হয়ে গেলেই মনটা পরিষ্কার হবে– একটু অনুতাপও হবে– সেইটেই সুযোগের সময়।”
রসিক।
কোপো যত্র ভ্রূকুটিরচনা নিগ্রহো যত্র মৌনং।
যত্রান্যোন্যস্মিতমনুনয় যত্র দৃষ্টিঃ প্রসাদঃ।
শৈল। রসিকদাদা, তুমি তো দিব্যি শ্লোক আউড়ে চলেছ– কোপ জিনিসটা কী, তা মুখুজ্যেমশায় টের পাবেন।
রসিক। আরে ভাই, বদল করতে রাজি আছি। মুখুজ্যেমশায় যদি শ্লোক আওড়াতেন আর আমার উপরেই যদি কোপ পড়ত তা হলে এই পোড়া কপালকে সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখতুম। কিন্তু দিদি, ঐ জলখাবারের থালা দুটি তো মান করে নি, বসে গেলে বোধ হয় আপত্তি নেই?
অক্ষয়। ঠিক ঐ কথাটাই ভাবছিলুম।
উভয়ে আহারে উপবেশন করিলেন, শৈলবালা পাখা লইয়া বাতাস করিতে লাগিলেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
আহারের পর শৈলবালা ডাকিল, “মুখুজ্যেমশায়।”
অক্ষয় অত্যন্ত ত্রস্তভাব দেখাইয়া কহিলেন, “আবার মুখুজ্যেমশায়! এই বালখিল্য মুনিদের ধ্যানভঙ্গ-ব্যাপারের মধ্যে আমি নেই।”
শৈলবালা। ধ্যানভঙ্গ আমরা করব। কেবল মুনিকুমারগুলিকে এই বাড়িতে আনা চাই।
অক্ষয় চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিলেন, “সভাসুদ্ধ এইখানে উৎপাটিত করে আনতে হবে। যত দুঃসাধ্য কাজ সবই এই একটিমাত্র মুখুজ্যেমশায়কে দিয়ে?”
শৈলবালা হাসিয়া কহিল, “মহাবীর হবার ঐ তো মুশকিল। যখন গন্ধমাদনের প্রয়োজন হয়েছিল তখন নল-নীল-অঙ্গদকে তো কেউ পোঁছেও নি!”
অক্ষয় গর্জন করিয়া কহিলেন, “ওরে পোড়ারমুখী ত্রেতাযুগের পোড়ারমুখোকে ছাড়া আর কোনো উপমাও তোর মনে উদয় হল না? এত প্রেম!”
শৈলবালা কহিল, “হাঁ গো, এতই প্রেম!”
অক্ষয় ভৈরোঁতে গাহিয়া উঠিলেন–
“পোড়া মনে শুধু পোড়া মুখখানি জাগে রে!
এত আছে লোক, তবু পোড়া চোখে
আর কেহ নাহি লাগে রে!
আচ্ছা, তাই হবে! পঙ্গপাল কটাকে শিখার কাছে তাড়িয়ে নিয়ে আসব। তা হলে চট্ করে আমাকে একটা পান এনে দাও। তোমার স্বহস্তের রচনা!”
শৈল। কেন দিদির হস্তের–
অক্ষয়। আরে, দিদির হস্ত তো জোগাড় করেইছি, নইলে পাণিগ্রহণ কী জন্যে? এখন অন্য পদ্মহস্তগুলির প্রতি দৃষ্টি দেবার অবকাশ পাওয়া গেছে।
শৈল। আচ্ছা গো মশায়! পদ্মহস্ত তোমার পানে এমনি চুন মাখিয়ে দেবে যে, পোড়ার মুখ আবার পুড়বে।
অক্ষয় গাহিলেন–
যারে মরণ দশায় ধরে
সে যে শতবার করে মরে।
পোড়া পতঙ্গ যত পোড়ে তত
আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
শৈল। মুখুজ্যেমশায়, ও কাগজের গোলাটা কিসের?
অক্ষয়। তোমাদের সেই সভ্য হবার আবেদনপত্র এবং প্রবেশিকার দশ টাকার নোট পকেটে ছিল, ধোবা বেটা কেচে এমনি পরিষ্কার করে দিয়েছে, একটা অক্ষরও দেখতে পাচ্ছি নে। ও বেটা বোধ হয় স্ত্রীস্বাধীনতার ঘোরতর বিরোধী, তাই তোমার ঐ পত্রটা একেবারে আগাগোড়া সংশোধন করে দিয়েছে।
শৈল। এই বুঝি!
অক্ষয়। চারটিতে মিলে স্মরণশক্তি জুড়ে বসে আছ, আর কিছু কি মনে রাখতে দিলে?–
সকলি ভুলেছে ভোলা মন
ভোলে নি ভোলে নি শুধু ওই চন্দ্রানন।
১০ নম্বর মধুমিস্ত্রির গলিতে একতলার একটি ঘরে চিরকুমার-সভার অধিবেশন হয়। বাড়িটি সভাপতি চন্দ্রমাধববাবুর বাসা। তিনি লোকটি ব্রাহ্ম কালেজের অধ্যাপক। দেশের কাজে অত্যন্ত উৎসাহী; মাতৃভূমির উন্নতির জন্য ক্রমাগতই নানা মতলব তাঁহার মাথায় আসিতেছে। শরীরটি কৃশ কিন্তু কঠিন, মাথাটা মস্ত, বড়ো দুইটি চোখ অন্যমনস্ক খেয়ালে পরিপূর্ণ। প্রথমটা সভায় সভ্য অনেকগুলি ছিল। সম্প্রতি সভাপতি বাদে তিনটিতে আসিয়া ঠেকিয়াছে। যুথভ্রষ্টগণ বিবাহ করিয়া গৃহী হইয়া রোজগারে প্রবৃত্ত। এখন তাঁহারা কোনোপ্রকার চাঁদার খাতা দেখিলেই প্রথমে হাসিয়া উড়াইয়া দেন, তাহাতেও খাতাধারী টিকিয়া থাকিবার লক্ষণ প্রকাশ করিলে গালি দিতে আরম্ভ করেন। নিজেদের দৃষ্টান্ত স্মরণ করিয়া দেশহিতৈষীর প্রতি তাঁহাদের অত্যন্ত অবজ্ঞা জন্মিয়াছে।
বিপিন শ্রীশ এবং পূর্ণ তিনটি সভ্য কালেজে পড়িতেছে, এখনো সংসারে প্রবেশ করে নাই। বিপিন ফুটবল খেলে, তাহার শরীরে অসামান্য বল, পড়াশুনা কখন করে কেহ বুঝিতে পারে না, অথচ চট্পট্ একজামিন পাস করে। শ্রীশ বড়োমানুষের ছেলে, স্বাস্থ্য তেমন ভালো নয়, তাই বাপ-মা পড়াশুনার দিকে তত বেশি উত্তেজনা করেন না– শ্রীশ নিজের খেয়াল লইয়া থাকে। বিপিন এবং শ্রীশের বন্ধুত্ব অবিচ্ছেদ্য।
পূর্ণ গৌরবর্ণ, একহারা, লঘুগামী, ক্ষিপ্রকারী, দ্রুতভাষী, সকল বিষয়ে গাঢ় মনোযোগ, চেহারা দেখিয়া মনে হয় দৃঢ়সংকল্প কাজের লোক।