বউ-ঠাকুরানীর হাট

খাঁ সাহেব চলিয়া গেল। সীতারাম কহিল, “একে একে নিবেদন করিতেছি মহারাজ।” বলিয়া একে একে যুবরাজের কারারোধের কথা কহিল। সীতারাম আগাগোড়া সত্য কথা বলে নাই। যে-কারণে উদয়াদিত্যের কারারোধ ঘটিয়াছিল, সে-কারণটা তেমন স্পষ্ট করিয়া বলে নাই।

বসন্ত রায়ের মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িল, তিনি সীতারামের হাত দৃঢ় করিয়া ধরিলেন। তাঁহার ভ্রূ ঊর্ধ্বে উঠিল, তাঁহার চক্ষু প্রসারিত হইয়া গেল, তাঁহার অধরৌষ্ঠ বিভিন্ন হইয়া গেল– নির্নিমেষ নেত্রে সীতারামের মুখের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “অ্যাঁ?”

সীতারাম কহিল, “আজ্ঞা, হাঁ মহারাজ।”

কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া বসন্ত রায় কহিলেন, “সীতারাম!”

সীতারাম। “মহারাজ।”

বসন্ত রায়। “তাহা হইলে দাদা এখন কোথায়?”

সীতারাম। “আজ্ঞা, তিনি কারাগারে।”

বসন্ত রায় মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন। উদয়াদিত্য কারাগারে, এ-কথাটা বুঝি তাঁহার মাথায় ভালো করিয়া বসিতেছে না, কিছুতেই কল্পনা করিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। আবার কিছুক্ষণ বাদে সীতারামের হাত ধরিয়া কহিলেন, “সীতারাম!”

সীতারাম। “আজ্ঞা মহারাজ।”

বসন্ত রায়। “তাহা হইলে দাদা এখন কী করিতেছে?”

সীতারাম। “কী আর করিবেন। তিনি কারাগারেই আছেন।”

বসন্ত রায়। “তাহাকে কি সকলে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছে?”

সীতারাম। “আজ্ঞা হাঁ মহারাজ।”

বসন্ত রায়। “তাহাকে কি কেহ একবার বাহির হইতে দেয় না?”

সীতারাম। “আজ্ঞা না।”

বসন্ত রায়। “সে একলা কারাগারে বসিয়া আছে?”

বসন্ত রায় এ-কথাগুলি বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করেন নাই– আপনা-আপনি বলিতেছিলেন। সীতারাম তাহা বুঝিতে পারে নাই– সে উত্তর করিল, “হাঁ মহারাজ।”

বসন্ত রায় বলিয়া উঠিলেন, “দাদা, তুই আমার কাছে আয় রে, তোকে কেহ চিনিল না।”

অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ

বসন্ত রায় তাহার পরদিনই যশোহরে যাত্রা করিলেন। কাহারও নিষেধ মানিলেন না। যশোহরে পৌঁছিয়াই একেবারে রাজবাটীর অন্তঃপুরে গেলেন। বিভা সহসা তাহার দাদামহাশয়কে দেখিয়া যেন কী হইয়া গেল। কিছুক্ষণ কী যে করিবে কিছু যেন ভাবিয়া পাইল না। কেবল চোখে বিস্ময়, অধরে আনন্দ, মুখে কথা নাই, শরীর নিস্পন্দ– খানিকটা দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পর তাঁহার পায়ের কাছে পড়িয়া প্রণাম করিল, পায়ের ধূলা মাথায় লইল। বিভা উঠিয়া দাঁড়াইলে পর বসন্ত রায় একবার নিতান্ত একাগ্রদৃষ্টে বিভার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিভা?” আর কিছু বলিলেন না, কেবল জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিভা?” যেন তাঁহার মনে একটি অতি ক্ষীণ আশা জাগিয়াছিল যে, সীতারাম যাহা বলিয়াছিল, তাহা সত্য না হইতেও পারে। সমস্তটা স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করিতে ভয় হইতেছে পাছে বিভা তাহার উত্তর দিয়া ফেলে। তাঁহার ইচ্ছা নয় যে বিভা তৎক্ষণাৎ তাঁহার এ প্রশ্নের উত্তর দেয়। তাই তিনি অতি ভয়ে ভয়ে বিভার মুখখানিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিভা?” তাই তিনি অতি একাগ্রদৃষ্টে তাহার মুখের দিকে একবার চাহিলেন। বিভা বুঝিল এবং বিভা উত্তর দিতেও পারিল না; তাহার প্রথম আনন্দ-উচ্ছ্বাস ফুরাইয়া গেছে। আগে যখন দাদামহাশয় আসিতেন, সেইসব দিন তাহার মনে পড়িয়াছে। সে এক কী উৎসবের দিনই গিয়াছে। তিনি আসিলে কী একটা আনন্দই পড়িত। সুরমা হাসিয়া তামাশা করিত, বিভা হাসিত কিন্তু তামাশা করিতে পারিত না, দাদা প্রশান্ত আনন্দমূর্তিতে দাদামহাশয়ের গান শুনিতেন। আজ দাদামহাশয় আসিলেন, কিন্তু আর কেহ তাঁহার কাছে আসিল না, কেবল এই আঁধার সংসারে একলা বিভা– সুখের সংসারের একমাত্র ভগ্নাবশেষের মতো একলা দাদামহাশয়ের কাছে দাঁড়াইয়া আছে। দাদামহাশয় আসিলে যে-ঘরে আনন্দধ্বনি উঠিত– সেই সুরমার ঘর আজ এমন কেন? সে আজ স্তব্ধ, অন্ধকার, শূন্যময়– দাদামহাশয়কে দেখিলেই সে- ঘরটা যেন এখনই কাঁদিয়া উঠিবে। বসন্ত রায় একবার কী যেন কিসের আশ্বাসে সেই ঘরের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন– দরজার কাছে দাঁড়াইয়া ঘরের মধ্যে মাথা লইয়া একবার চারিদিকে দেখিলেন, তৎক্ষণাৎ মুখ ফিরাইয়া বুকফাটা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিদি, ঘরে কি কেহই নাই?”

বিভা কাঁদিয়া কহিল, “না দাদামহাশয়, কেহই নাই।”

স্তব্ধ ঘরটা যেন হা হা করিয়া বলিয়া উঠিল, “আগে যাহারা ছিল তাহারা কেহই নাই।”

বসন্ত রায় অনেকক্ষণ পর্যন্ত চূপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন, অবশেষে বিভার হাত ধরিয়া আস্তে আস্তে গাহিয়া উঠিলেন,

আমি শুধু রইনু বাকি।

বসন্ত রায় প্রতাপাদিত্যের কাছে গিয়া নিতান্ত মিনতি করিয়া কহিলেন, “বাবা প্রতাপ, উদয়কে আর কেন কষ্ট দাও– সে তোমার কী করিয়াছে? তাহাকে যদি তোমরা ভালো না বাস, পদে পদেই যদি সে তোমার কাছে অপরাধ করে তবে তাহাকে এই বুড়োর কাছে দাও না। আমি তাহাকে লইয়া যাই– আমি তাহাকে রাখিয়া দিই। তাহাকে আর তোমাকে দেখিতে হইবে না– সে আমার কাছে থাকিবে!”

প্রতাপাদিত্য অনেকক্ষণ পর্যন্ত ধৈর্য ধরিয়া চুপ করিয়া বসন্ত রায়ের কথা শুনিলেন, অবশেষে বলিলেন, “খুড়ামহাশয়, আমি যাহা করিয়াছি তাহা অনেক বিবেচনা করিয়াই করিয়াছি, এ-বিষয়ে আপনি অবশ্যই আমার অপেক্ষা অনেক অল্প জানেন– অথচ আপনি পরামর্শ দিতে আসিয়াছেন, আপনার এ-সকল কথা আমি গ্রাহ্য করিতে পারি না।”

তখন বসন্ত রায় উঠিয়া প্রতাপাদিত্যের কাছে আসিয়া প্রতাপাদিত্যের হাত ধরিয়া কহিলেন, “বাবা প্রতাপ, মনে কি নাই! তোকে যে আমি ছেলেবেলায় কোলে পিঠে করিয়া মানুষ করিলাম, সে কি আর মনে পড়ে না? স্বর্গীয় দাদা যেদিন তোকে আমার হাতে সমর্পণ করিয়া গিয়াছেন, সেদিন হইতে আমি কি এক মুহূর্তের জন্য তোকে কষ্ট দিয়াছি? অসহায় অবস্থায় যখন তুই আমার হাতে ছিলি, একদিনও কি তুই আপনাকে পিতৃহীন বলিয়া মনে করিতে পারিয়াছিলি? প্রতাপ, বল্‌ দেখি, আমি তোর কী অপরাধ করিয়াছিলাম যাহাতে আমার এই বৃদ্ধ বয়সে তুই আমাকে এত কষ্ট দিতে পারিলি? এমন কথা আমি বলি না যে, তোকে পালন করিয়াছিলাম বলিয়া তুই আমার কাছে ঋণী– তোদের মানুষ করিয়া আমিই আমার দাদার স্নেহ-ঋণ শোধ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। অতএব প্রতাপ, আমি প্রাপ্য বলিয়া তোর কাছে কিছুই চাহি না, কখনো চাহিও নাই, আমি কেবল তোর কাছে ভিক্ষা চাহিতেছি– তাও দিবি না?”

0 Shares