বউ-ঠাকুরানীর হাট

এমন সময়ে একজন রমণী কর্কশ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “এই যে গা, এইখানে তোমাদের যুবরাজ– এইখানে!”

দুইজন সৈন্য মশাল হাতে করিয়া যুবরাজের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। দেখিতে দেখিতে আরো অনেকে আসিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া ফেলিল। তখন সেই রমণী তাঁহার কাছে আসিয়া কহিল, “আমাকে চিনিতে পার কি গা। একবার এইদিকে তাকাও! একবার এইদিকে তাকাও!” যুবরাজ মশালের আলোকে দেখিলেন, রুক্মিণী। সৈন্যগণ রুক্মিণীর ব্যবহার দেখিয়া তাহাকে ধমক দিয়া কহিল, “দূর হ মাগী।” সে তাহাতে কর্ণপাতও না করিয়া কহিতে লাগিল, “এ-সব কে করিয়াছে? আমি করিয়াছি। এ-সব কে করিয়াছে? আমি করিয়াছি। এ-সব সৈন্যদের এখানে কে আনিয়াছে? আমি আনিয়াছি। আমি তোমার লাগিয়া এত করিলাম, আর তুমি–।” যুবরাজ ঘৃণায় রুক্মিণীর দিকে পশ্চাৎ ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। সৈন্যগণ রুক্মিণীকে বলপূর্বক ধরিয়া তফাত করিয়া দিল। তখন মুক্তিয়ার খাঁ সম্মুখে আসিয়া যুবরাজকে সেলাম করিয়া দাঁড়াইল। যুবরাজ বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “মুক্তিয়ার খাঁ, কী খবর?”

মুক্তিয়ার খাঁ বিনীতভাবে কহিল, “জনাব, আমাদের মহারাজের নিকট হইতে আদেশ লইয়া আসিতেছি।”

যুবরাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী আদেশ।”

মুক্তিয়ার খাঁ প্রতাপাদিত্যের স্বাক্ষরিত আদেশপত্র বাহির করিয়া যুবরাজের হাতে দিল।

যুবরাজ পড়িয়া কহিলেন, “ইহার জন্য এত সৈন্যের প্রয়োজন কী? আমাকে একখানা পত্র লিখিয়া আদেশ করিলেই তো আমি যাইতাম। আমি তো আপনিই যাইতেছিলাম, যাইব বলিয়াই স্থির করিয়াছি। তবে আর বিলম্বে প্রয়োজন কী? এখনই চলো। এখনই যশোহরে ফিরিয়া যাই।” মুক্তিয়ার খাঁ হাত জোড় করিয়া কহিল, “এখনই ফিরিতে পারিব না।” যুবরাজ ভীত হইয়া কহিলেন, “কেন?” মুক্তিয়ার খাঁ কহিল, “আর-একটি আদেশ আছে, তাহা পালন না করিয়া যাইতে পারিব না।”

যুবরাজ ভীতস্বরে কহিলেন, “কী আদেশ!”

মুক্তিয়ার খাঁ কহিল, “রায়গড়ের রাজার প্রতি মহারাজা প্রাণদণ্ডের আদেশ করিয়াছেন।”

যুবরাজ চমকিয়া উচ্চস্বরে কহিয়া উঠিলেন, “না, করেন নাই, মিথ্যা কথা।”

মুক্তিয়ার খাঁ কহিল, “আজ্ঞা যুবরাজ, মিথ্যা নহে। আমার নিকট মহারাজের স্বাক্ষরিত পত্র আছে।”

যুবরাজ সেনাপতির হাত ধরিয়া ব্যগ্র হইয়া কহিলেন, “মুক্তিয়ার খাঁ, তুমি ভুল বুঝিয়াছ। মহারাজ আদেশ দিয়াছেন যে, যদি উদয়াদিত্যকে না পাও, তাহা হইলে বসন্ত রায়ের– আমি যখন আপনি ধরা দিতেছি তখন আর কী! আমাকে এখনই লইয়া চলো, এখনই লইয়া চলো– আমাকে বন্দী করিয়া লইয়া চলো, আর বিলম্ব করিয়ো না।”

মুক্তিয়ার খাঁ কহিল, “যুবরাজ, আমি ভুল বুঝি নাই। মহারাজ স্পষ্ট আদেশ করিয়াছেন।”

যুবরাজ অধীর হইয়া কহিলেন, “তুমি নিশ্চয়ই ভুল বুঝিয়াছ! তাঁহার অভিপ্রায় এরূপ নহে। আচ্ছা চলো, যশোহরে চলো। আমি মহারাজের সম্মুখে তোমাদের বুঝাইয়া দিব, তিনি যদি দ্বিতীয় বার আদেশ করেন, তবে আদেশ সম্পন্ন করিয়ো।”

মুক্তিয়ার জোড়হস্তে কহিল, “যুবরাজ, মার্জনা করুন তাহা পারিব না।” যুবরাজ অধিকতর অধীর হইয়া কহিলেন, “মুক্তিয়ার, মনে আছে, আমি এক কালে সিংহাসন পাইব? আমার কথা রাখো, আমাকে সন্তুষ্ট করো।”

মুক্তিয়ার নিরুত্তরে দাঁড়াইয়া রহিল।

যুবরাজের মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল, তাঁহার কপালে ঘর্মবিন্দু দেখা দিল। তিনি সেনাপতির হাত দৃঢ়ভাবে ধরিয়া কহিলেন, “মুক্তিয়ার খাঁ, বৃদ্ধ নিরাপরাধ পুণ্যাত্মাকে বধ করিলে নরকেও তোমার স্থান হইবে না।”

মুক্তিয়ার খাঁ কহিল, “মনিবের আদেশ পালন করিতে পাপ নাই।”

উদয়াদিত্য উচ্চৈঃস্বরে কহিয়া উঠিলেন, “মিথ্যা কথা। যে ধর্মশাস্ত্রে তাহা বলে, সে ধর্মশাস্ত্র মিথ্যা। নিশ্চয়ই জানিয়ো মুক্তিয়ার, পাপ আদেশ পালন করিলে পাপ।”

মুক্তিয়ার নিরুত্তরে দাঁড়াইয়া রহিল।

উদয়াদিত্য চারিদিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, “তবে আমাকে ছাড়িয়া দাও। আমি গড়ে ফিরিয়া যাই। তোমার সৈন্যসামন্ত লইয়া সেখানে যাও, আমি তোমাকে যুদ্ধে আহ্বান করিতেছি। সেখানে রণক্ষেত্রে জয়লাভ করিয়া তার পরে তোমার আদেশ পালন করিয়ো।”

মুক্তিয়ার নিরুত্তরে দাঁড়াইয়া রহিল। সৈন্যগণ অধিকতর ঘেঁষিয়া আসিয়া যুবরাজকে ঘিরিল। যুবরাজ কোনো উপায় না দেখিয়া সেই অন্ধকারে প্রাণপণে চীৎকার করিয়া উঠিলেন, “দাদামহাশয়, সাবধান।” বন কাঁপিয়া উঠিল, মাঠের প্রান্তে গিয়া সে সুর মিলাইয়া গেল। সৈন্যেরা আসিয়া উদয়াদিত্যকে ধরিল। উদয়াদিত্য আর-একবার চীৎকার করিয়া উঠিলেন, “দাদামহাশয়, সাবধান।” এক জন পথিক মাঠ দিয়া যাইতেছিল– শব্দ শুনিয়া কাছে আসিয়া কহিল, “কে গা।” উদয়াদিত্য তাড়াতাড়ি কহিলেন, “যাও যাও, গড়ে ছুটিয়া যাও, মহারাজকে সাবধান করিয়া দাও।” দেখিতে দেখিতে সেই পথিককে সৈন্যেরা গ্রেপ্তার করিল। যে কেহ সেই মাঠ দিয়া চলিয়াছিল, সৈন্যেরা অবিলম্বে তাহাকে বন্দী করিল।

কয়েকজন সৈন্য উদয়াদিত্যকে বন্দী করিয়া রহিল, মুক্তিয়ার খাঁ এবং অবশিষ্ট সৈন্যগণ সৈনিকের বেশ পরিত্যাগ করিয়া অস্ত্রশস্ত্র লুকাইয়া সহজ বেশে গড়ের অভিমুখে গেল। রায়গড়ের শতাধিক দ্বার ছিল, ভিন্ন ভিন্ন দ্বার দিয়া তাহারা গড়ের মধ্যে প্রবেশ করিল।

তখন সন্ধ্যাকালে বসন্ত রায় বসিয়া আহ্নিক করিতেছিলেন। ওদিকে রাজবাড়ির ঠাকুরঘরে সন্ধ্যাপূজার শাঁখ ঘণ্টা বাজিতেছে। বৃহৎ রাজবাটীতে কোনো কোলাহল নাই, চারিদিক নিস্তব্ধ। বসন্ত রায়ের নিয়মানুসারে অধিকাংশ ভৃত্য সন্ধ্যাবেলায় কিছুক্ষণের জন্য ছুটি পাইয়াছে।

0 Shares