মালঞ্চ

“সমস্ত আবার নূতন লাগছে আমার।”

“তার পরে জান হঠাৎ সবই ডুবল। যখন ডাঙায় টেনে তুলল বন্যা থেকে, তখন আর-একবার আদিতদার পাশে এসে ঠেকল আমার ভাগ্য। মিললুম তেমনি করেই– আমরা দুই ভাই, আমরা দুই বন্ধু। তারপর থেকে আদিতদার আশ্রয়ে আছি এও যেমন সত্যি, তাঁকে আশ্রয় দিয়েছি সেও তেমনি সত্যি। পরিমাণে আমার দিক থেকে কিছু কম হয় নি এ আমি জোর করে বলব। তাই আমার পক্ষে একটুও কারণ ঘটে-নি সংকোচ করবার। এর আগে একত্রে ছিলেম যখন, তখন আমাদের যে-বয়স ছিল সেই বয়সটা নিয়েই যেন ফিরলুম, সেই সম্বন্ধ নিয়ে। এমনি করেই চিরদিন চলে যেতে পারত। আর বলে কী হবে।”

“কথাটা শেষ করে ফেলো।”

“হঠাৎ আমাকে ধাক্কা মেরে কেন জানিয়ে দিলে যে আমার বয়স হয়েছে। যেদিনকার আড়ালে একসঙ্গে কাজ করেছি সেদিনকার আবরণ উড়ে গেছে এক মুহূর্তে। তুমি নিশ্চয় সব জান রমেনদা, আমার কিছুই ঢাকা থাকে না তোমার চোখে। আমার উপরে বউদির রাগ দেখে প্রথম প্রথম ভারি আশ্চর্য লেগেছিল, কিছুতেই বুঝতে পারি নি। এতদিন দৃষ্টি পড়ে নি নিজের উপর, বউদিদির বিরাগের আগুনের আভায় দেখতে পেলেম নিজেকে, ধরা পড়লুম নিজের কাছে। আমার কথা বুঝতে পারছ কি।”

“তোমার ছেলেবেলাকার তলিয়ে-থাকা ভালোবাসা নাড়া খেয়ে ভেসে উঠছে উপরের তলায়।”

“আমি কী করব বলো। নিজের কাছ থেকে নিজে পালাই কী করে।” বলতে বলতে রমেনের হাত চেপে ধরলে।

রমেন চুপ করে রইল। আবার সে বললে, “যতক্ষণ এখানে আছি ততক্ষণ বেড়ে চলেছে আমার অন্যায়।”

“অন্যায় কার উপরে।”

“বউদির উপরে।”

“দেখো সরলা, আমি মানি নে ও-সব পুঁথির কথা। দাবির হিসেব বিচার করবে কোন্‌ সত্য দিয়ে। তোমাদের মিলন কতকালের; তখন কোথায় ছিল বউদি।”

“কী বলছ রমেনদা! আপন ইচ্ছের দোহাই দিয়ে এ কী আবদারের কথা। আদিতদার কথাও তো ভাবতে হবে।”

“হবে বৈকি। তুমি কি ভাবছ, যে-আঘাতে চমকিয়ে দিয়েছে তোমাকে, সেই আঘাতটাই তাঁকে লাগে নি।”

“রমেন নাকি।” পিছন থেকে শোনা গেল।

“হাঁ দাদা।” রমেন উঠে পড়ল।

“তোমার বউদি তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, আয়া এসে এইমাত্র জানিয়ে গেল।”

রমেন চলে গেল, সরলাও তখনি উঠে যাবার উপক্রম করলে।

আদিত্য বললে, “যেয়ো না সরি, একটু বোসো।” আদিত্যের মুখ দেখে সরলার বুক ফেটে যেতে চায়। ঐ অবিশ্রাম কর্মরত আপনা-ভোলা মস্ত মানুষটা এতক্ষণ যেন কেবল পাক খেয়ে বেড়াচ্ছিল হালভাঙা ঢেউখাওয়া নৌকার মতো।

আদিত্য বললে, “আমরা দুজনে এ সংসারে জীবন আরম্ভ করেছিলেম একেবারে এক হয়ে। এত সহজ আমাদের মিল যে এর মধ্যে কোনো ভেদ কোনো কারণে ঘটতে পারে সে কথা মনে করাই অসম্ভব। তাই কি নয় সরি।”

“অঙ্কুরে যা এক থাকে, বেড়ে উঠে তা ভাগ হয়ে যায় এ কথা না মেনে তো থাকবার জো নেই আদিতদা।”

“সে ভাগ তো বাইরে, কেবল চোখে দেখার ভাগ। অন্তরে তো প্রাণের মধ্যে ভাগ হয় না। আজ তোমাকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নেবার ধাক্কা এসেছে। আমাকে যে এত বেশি বাজবে এ আমি কোনোদিন ভাবতেই পারতুম না। সরি, তুমি কি জান কী ধাক্কাটা এল হঠাৎ আমাদের

‘পরে।”

“জানি ভাই, তুমি জানবার আগে থাকতেই।”

“সইতে পারবে সরি?”

“সইতেই হবে।”

“মেয়েদের সহ্য করবার শক্তি কি আমাদের চেয়ে বেশি, তাই ভাবি।”

“তোমরা পুরুষমানুষ দুঃখের সঙ্গে লড়াই কর, মেয়েরা যুগে যুগে দুঃখ কেবল সহ্যই করে। চোখের জল আর ধৈর্য, এ ছাড়া আর তো কিছুই সম্বল নেই তাদের।”

“তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে যাবে এ আমি ঘটতে দেব না, দেব না। এ অন্যায়, এ নিষ্ঠুর অন্যায়।” –ব’লে মুঠো শক্ত করে আকাশে কোন্‌ অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে প্রস্তুত হল।

সরলা কোলের উপর আদিত্যের হাতখানা নিয়ে তার উপরে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বলে গেল যেন আপন মনে ধীরে ধীরে, “ন্যায় অন্যায়ের কথা নয় ভাই, সম্বন্ধের বন্ধন যখন ফাঁস হয়ে ওঠে তার ব্যথা বাজে নানা লোকের মধ্যে, টানাটানি পড়ে নানা দিক থেকে, কাকেই বা দোষ দেব।”

“তুমি সহ্য করতে পারবে তা জানি। একদিনের কথা মনে পড়ছে। কী চুল ছিল তোমার, এখনো আছে। সে চুলের গর্ব ছিল তোমার মনে। সবাই সেই গর্বে প্রশ্রয় দিত। একদিন ঝগড়া হল তোমার সঙ্গে। দুপুরবেলা বালিশের ‘পরে চুল মেলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলে, আমি কাঁচি হাতে অন্তত আধহাতখানেক কেটে দিলাম। তখনই জেগে তুমি দাঁড়িয়ে উঠলে, তোমার ঐ কালো চোখ আরো কালো হয়ে উঠল। শুধু বললে, “মনে করেছ আমাকে জব্দ করবে?’ ব’লে আমার হাত থেকে কাঁচি টেনে নিয়ে ঘাড় পর্যন্ত চুল কেটে ফেললে কচ কচ করে। মেসোমশায় তোমাকে দেখে আশ্চর্য। বললেন, “এ কী কাণ্ড।’ তুমি শান্তমুখে অনায়াসে বললে, “বড়ো গরম লাগে।’ তিনিও একটু হেসে সহজেই মেনে নিলেন। প্রশ্ন করলেন না, ভৎসনা করলেন না, কেবল কাঁচি নিয়ে সমান করে দিলেন তোমার চুল। তোমারই তো জেঠামশায়!”

সরলা হেসে বললে, “তোমার যেমন বুদ্ধি! তুমি ভাবছ এটা আমার ক্ষমার পরিচয়? একটুকুও নয়। সেদিন তুমি আমাকে যতটা জব্দ করেছিলে তার চেয়ে অনেক বেশি জব্দ করেছিলুম আমি তোমাকে। ঠিক কি না বলো।”

“খুব ঠিক। সেই কাটা চুল দেখে আমি কেবল কাঁদতে বাকি রেখেছিলুম। তার পরদিন তোমাকে মুখ দেখাতে পারি নি লজ্জায়। পড়বার ঘরে চুপ করে ছিলেম বসে। তুমি ঘরে ঢুকেই হাত ধরে আমাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলে বাগানের কাজে, যেন কিছুই হয় নি।

0 Shares