মালঞ্চ

“আচ্ছা সেই ভালো, তা হলে আমি কী করব।”

“তুমি তোমার দোকান নিয়ে থাকো; সেখানে তোমার আপিসের কাজ তো কম নয়।”

“তোমাকে নিয়ে থাকাও তা হলে নিষিদ্ধ?”

“হাঁ, সর্বদা কাছে থাকবার মতো সে আমি আর নেই, এখন আমি কেবল আর একজনকে মনে করিয়েই দিতে পারি, তাতে লাভ কি।”

“আচ্ছা বেশ। যখন তুমি আমাকে সহ্য করতে পারবে তখনই আসব। ডেকে পাঠিয়ো আমাকে। আজ সাজিতে তোমার জন্যে গন্ধরাজ এনেছি, রেখে যাই তোমার বিছানায়, কিছু মনে কোরো না।” ব’লে আদিত্য উঠে পড়ল।

নীরজা হাতে ধরে বললে, “না, যেয়ো না, একটু বোসো।” ফুলদানিতে একটা ফুল দেখিয়ে বললে, “জান এ ফুলের নাম?”

আদিত্য জানে কি জবাব দিলে ও খুশি হবে, তাই মিথ্যে করে বললে, “না, জানি নে।”

“আমি জানি। বলব? পেট্যুনিয়া। তুমি মনে কর আমি কিচ্ছু জানি নে, মুর্খু আমি!”

আদিত্য হেসে বললে, “সহধর্মিণী তুমি, যদি মুর্খ হও অন্তত আমার সমান মুর্খ। আমাদের জীবনে মুর্খতার কারবার আধাআধি ভাগে চলছে।”

“সে কারবার আমার ভাগ্যে এইবারে শেষ হয়ে এল। ঐ-যে দারোয়ানটা ঐখানে বসে তামাক কুটছে, ও থাকবে দেউড়িতে, কিছুদিন পরেই আমি থাকব না। ঐ– যে গোরুর গাড়িটা পাথুরে কয়লা আজাড় করে দিয়ে খালি ফিরে যাচ্ছে ওর যাতায়াত চলবে রোজ রোজ, কিন্তু চলবে না আমার এই হৃদয়যন্ত্রটা।” আদিত্যের হাত হঠাৎ জোর করে চেপে ধরলে, বললে, “একেবারেই থাকব না, কিচ্ছুই থাকব না? বলো আমাকে, তুমি তো অনেক বই পড়েছ, বলো-না আমাকে সত্যি করে।”

“যাদের বই পড়েছি তাদের বিদ্যে যতদূর আমারও ততদূর! যমের দরজার কাছটাতে এসে থেমেছি, আর এগোই নি।”

“বলো -না, তুমি কী মনে কর। একটুও থাকব না? এতটুকুও না। ”

“এখন আছি এটাই যদি সম্ভব হয়, তখন থাকব সেও সম্ভব।”

“নিশ্চয়ই সম্ভব, ঐ বাগানটা সম্ভব আর আমিই হব অসম্ভব, এ হতেই পারে না, কিছুতেই না। সন্ধেবেলায় অমনি করেই অস্পষ্ট আলোয় কাকেরা ফিরবে বাসায়, এমনি করেই দুলবে সুপুরিগাছের ডাল ঠিক আমারই চোখের সামনে। সেদিন তুমি মনে রেখো আমি আছি, আমি আছি , সমস্ত বাগানময় আমি আছি। মনে কোরো বাতাস যখন তোমার চুল ওড়াচ্ছে আমার আঙুলের ছোঁয়া আছে তাতে। বলো, মনে করবে? ”

আদিত্যকে বলতে হল, “হাঁ, মনে করব।” কিন্তু এমন সুরে বলতে পারলে না যাতে তার বিশ্বাসের প্রমাণ হয়।

নীরজা অস্থির হয়ে বলে উঠল, “তোমাদের বই যারা লেখে ভারি তো পণ্ডিত তারা, কিচ্ছু জানে না। আমি নিশ্চয় জানি, আমার কথা বিশ্বাস করো। আমি থাকব, আমি এইখানেই থাকব, আমি তোমারই কাছে থাকব, একেবারে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এই তোমাকে বলে যাচ্ছি, কথা দিয়ে যাচ্ছি তোমার বাগানের গাছপালা সমস্তই আমি দেখব, যেমন আগে দেখতুম তার চেয়ে অনেক ভাল করে দেখব। কাউকে দরকার হবে না। কাউকে না।”

বিছানায় শুয়ে ছিল নীরজা ; উঠে বাসিশে ঠেসান দিয়ে বসল, বললে, “আমাকে দয়া কোরো, দয়া কোরো। তোমাকে এত ভালোবাসি সেই কথা মনে ক’রে আমাকে দয়া কোরো। এতদিন তুমি আমাকে যেমন আদরে স্থান দিয়েছ তোমার ঘরে, সেদিনও তেমনি করেই স্থান দিয়ো। ঋতুতে ঋতুতে তোমার যে-সব ফুল ফুটবে তেমনি করেই মনে মনে তুলে দিয়ো আমার হাতে। যদি নিষ্ঠুর হও তুমি, তা হলে তো এখানে আমি থাকতে পারব না। আমার বাগান যদি কেড়ে নাও তা হালে হাওয়ায় হাওয়ায় কোন্‌ শূন্যে আমি ভেসে বেড়াব?” নীরজার দুই চক্ষু দিয়ে জল ঝরে পড়তে লাগল।

আদিত্য মোড়া ছেড়ে বিছানার উপর উঠে বসল। নীরজার মুখ বুকে টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে হাত বুলোতে লাগল তার মাথায়। বললে, “নীরু, শরীর নষ্ট কোরো না।”

“যাক গে আমার শরীর। আমি আর কিচ্ছু চাই নে, আমি কেবল তোমাকে চাই এই সমস্ত কিছু নিয়ে। শোনো একটা কথা বলি, রাগ কোরো না আমার উপর, রাগ কোরো না,” বলতে বলতে স্বর রূদ্ধ হয়ে এল। একটু শান্ত হলে পর বললে, “সরলার উপর অন্যায় করেছি। তোমার পায়ে ধরে বলছি আর অন্যায় করব না। যা হয়েছে, তার জন্যে আমাকে মাপ কোরো। কিন্তু আমাকে ভালোবাসো, ভালোবাসো তুমি, যা চাও আমি সব করব।”

আদিত্য বললে, “শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মন ছিল অসুস্থ নীরু, তাই নিজেকে মিথ্যা পীড়ন করেছ।”

“শোনো বলি। কাল রাত্রি থেকে বারবার পণ করেছি, এবার দেখা হলে নির্মল মনে ওকে বুকে টেনে নেব আপন বোনের মতো। তুমি আমাকে এই শেষ প্রতিজ্ঞা-রক্ষায় সাহায্য করো। বলো, আমি তোমার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হব না, তা হলে সবাইকে আমার ভালোবাসা দিয়ে যেতে পারব।”

এ কথার কোনো উত্তর না করে আদিত্য বারবার চুম্বন করলে ওর মুখ, ওর কপাল। মুদে এল নীরজার চোখ। খানিক বাদে নীরজা জিজ্ঞাসা করলে, “সরলা কবে খালাস পাবে সেই দিন গুণছি। ভয় হয় পাছে তার আগে মরে যাই। পাছে বলে যেতে না পারি যে আমার মন একেবারে সাদা হয়ে গেছে। এইবার আলো জ্বালাও। আমাকে পড়ে শোনাও অক্ষয় বড়ালের “এষা’। বালিশের নীচে থেকে বই বের করে দিলে। আদিত্য পড়ে শোনাতে লাগল।

শুনতে শুনতে যেই একটু ঘুম এসেছে আয়া ঘরে এসে বলল, “চিঠি”, ঘোর ভেঙে নীরজা চমকে উঠল। ধড় ধড় করতে লাগল তার বুক। কোনো বন্ধু আদিত্যকে খবর দিয়েছে, জেলে স্থানাভাব, তাই যে-কয়েদীকে মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার আগেই ছেড়ে দেওয়া হবে সরলা তার মধ্যে একজন। আদিত্যের মনটা লাফিয়ে উঠল। প্রাণপণ বলে চেপে রাখলে মনের উল্লাস। নীরজা জিজ্ঞাসা করলে “কার চিঠি, কী খবর।”

0 Shares