মালঞ্চ

নীরজা তার মুখের দিকে তাকালে না, সরলা ধীরে ধীরে ফুলটি বিছানায় তার সামনে রেখে দিলে।

নীরজা বিরক্তির ভাব গোপন না করেই বললে, ” কে আনতে বলেছে।”

“আদিতদা।”

“নিজে এলেন না যে?”

“নিয়ু মার্কেটের দোকানে তাড়াতাড়ি যেতে হল চা খাওয়া সেরেই।”

“এত তাড়া কিসের।”

“কাল রাত্রে আপিসের তালা ভেঙে টাকা-চুরির খবর এসেছে।”

“টানাটানি করে কি পাঁচ মিনিটও সময় দিতে পারতেন না।”

“কাল রাত্রে তোমার ব্যথা বেড়েছিল। ভোরবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলে। দরজার কাছ পর্যন্ত এসে ফিরে গেলেন। আমাকে বলে গেলেন দুপুরের মধ্যে যদি নিজে না আসতে পারেন এই ফুলটি যেন দিই তোমাকে।”

দিনের কাজ আরম্ভের পূর্বেই রোজ আদিত্য বিশেষ বাছাই-করা একটি করে ফুল স্ত্রীর বিছানায় রেখে যেত। নীরজা প্রতিদিন তারই অপেক্ষা করেছে। আজকের দিনের বিশেষ ফুলটি আদিত্য সরলার হাতে দিয়ে গেল। এ কথা তার মনে আসে নি যে, ফুল দেওয়ার প্রদান মূল্য নিজের হাতে দেওয়া। গঙ্গার জল হলেও নলের ভিতর থেকে তার সার্থকতা থাকে না।

নীরজা ফুলটা অবজ্ঞার সঙ্গে ঠেলে দিয়ে বললে, “জান মার্কেটে এ ফুলের দাম কত? পাঠিয়ে দাও সেখানে, মিছে নষ্ট করবার দরকার কী।” বলতে বলতে গলা ভার হয়ে এল।

সরলা বুঝলে ব্যাপারখানা। বুঝলে জবাব দিতে গেলে আক্ষেপের বেগ বাড়বে বৈ কমবে না। চুপ করে রইল দাঁড়িয়ে। একটু পরে খামখা নীরজা প্রশ্ন করলে, “জান এ ফুলের নাম?”

বললেই হত, জানি নে, কিন্তু বোধ করি অভিমানে ঘা লাগল, বললে, “এমারিলিস।”

নীরজা অন্যায় উষ্মার সঙ্গে ধমক দিলে, “ভারি তো জান তুমি; ওর নাম গ্র৻াণ্ডিফ্লোরা।”

সরলা মৃদুস্বরে বললে, “তা হবে।”

“তা হবে মানে কী। নিশ্চয়ই তাই। বলতে চাও, আমি জানি নে?”

সরলা জানত নীরজা জেনেশুনেই ভুল নামদিয়ে প্রতিবাদ করলে। অন্যকে জ্বালিয়ে নিজের জ্বালা উপশম করবার জন্যে। নীরবে হার মেনে ধীরে ধীরে বেরিয়ে চলে যাচ্ছিল, নীরজা ফিরে ডাকল, “শুনে যাও। কী করছিলে সমস্ত সকাল, কোথায় ছিলে।”

“অর্‌কিডের ঘরে।”

নীরজা উত্তেজিত হয়ে বললে, “অর্‌কিডের ঘরে তোমার ঘন ঘন যাবার এত কী দরকার।”

“পুরোনো অর্‌কিড চিরে ভাগ করে নতুন অর্‌কিড করবার জন্যে আদিতদা আমাকে বলে গিয়েছিলেন।”

নীরজা বলে উঠল ধমক দেওয়ার সুরে, “আনাড়ির মতো সব নষ্ট করবে তুমি। আমি নিজের হাতে হলা মালীকে তৈরি করে শিখিয়েছি, তাকে হুকুম করলে সে কি পারত না।”

এর উপর জবার চলে না। এর অকপট উত্তরটা ছিল এই যে, নীরজার হাতে হলা মালীর কাজ চলত ভালোই, কিন্তু সরলার হাতে একেবারেই চলে না। এমন-কি, ওকে সে অপমান করে ঔদাসীন্য দেখিয়ে।

মালী এটা বুঝে নিয়েছিল যে, এ আমলে ঠিকমত কাজ না করলেই ও-আমলের মনিব হবেন খুশি। এ যেন কলেজ বয়কট করে পাস না করার দামটাই ডিগ্রি পাওয়ার চেয়ে বড়ো হয়েছে।

সরলা রাগ করতে পারত কিন্তু রাগ করলে না। সে বোঝে বউদিদির বুকের ভিতরটা টনটন করছে। নিঃসন্তান মায়ের সমস্ত হৃদয় জুড়েছে যে বাগান, দশ বছর পরে আজ এত কাছে আছে, তবু এই বাগানের থেকে নির্বাসন। চোখের সামনেই নিষ্ঠুর বিচ্ছেদ। নীরজা বললে, “দাও, বন্ধ করে দাও ঐ জানলা।” সরলা বন্ধ করে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “এইবার কমলালেবুর রস নিয়ে আসি।”

“না, কিছু আনতে হবে না, এখন যেতে পারো।”

সরলা ভয়ে ভয়ে বললে, “মকরধ্বজ খাবার সময় হয়েছে।”

“না, দরকার নেই মকরধ্বজ। তোমার উপর বাগানের আর কোনো কাজের ফরমাশ আছে নাকি।”

“গোলাপের ডাল পুঁততে হবে।”

নীরজা একটু খোঁটা দিয়ে বললে, “তার সময় এই বুঝি! এ বুদ্ধি তাঁকে দিলে কে শুনি।”

সরলা মৃদুস্বরে বললে, “মফস্বল থেকে হঠাৎ অনেকগুলো অর্ডার এসেছে দেখে কোনোমতে আসছে বর্ষার আগেই বেশি করে গাছ বানাতে পণ করেছেন। আমি বারণ করেছিলুম।”

“বারণ করেছিলে বুঝি! আচ্ছা, আচ্ছা, ডেকে দাও হলা মালীকে।”

এল হলা মালী। নীরজা বললে, “বাবু হয়ে উঠেছ? গোলাপের ডাল পুঁততে হাতে খিল ধরে! দিদিমণি তোমার অ্যাসিস্টেন্ট মালী নাকি। বাবু শহর থেকে ফেরবার আগেই যতগুলো পারিস ডাল পুঁতবি, আজ তোদের ছুটি নেই বলে দিচ্ছি। পোড়া ঘাসপাতার সঙ্গে বালি মিশিয়ে জমি তৈরি করে নিস ঝিলের ডান পাড়িতে।” মনে মনে স্থির করলে এইখানে শুয়ে-শুয়েই গোলাপের গাছ সে তৈরি করে তুলবেই। হলা মালীর আর নিষ্কৃতি নেই।

হঠাৎ হলা প্রশ্রয়ের হাসিতে মুখ ভরে বললে, “বউদিদি, এই একটা পিতলের ঘটি। কটকের হরসুন্দর মাইতির তৈরি। এ জিনিসের দরদ তুমিই বুঝবে। তোমার ফুলদানি মানাবে ভালো।”

নীরজা জিজ্ঞাসা করলে, “এর দাম কত।”

জিভ কেটে হলা বললে, “এমন কথা বোলো না। এ ঘটির আবার দাম নেব! গরিব আমি, তা বলে তো ছোটোলোক নই। তোমারই খেয়ে-পরে যে মানুষ।”

ঘটি টিপাইয়ের উপর রেখে অন্য ফুলদানি থেকে ফুল নিয়ে সাজাতে লাগল। অবশেষে যাবার-মুখো হয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, “তোমাকে জানিয়েছি আমার ভাগনীর বিয়ে। বাজুবন্ধর কথা ভুলো না বউদিদি। পিতলের গয়না যদি দিই তোমারই নিন্দে হবে। এতবড়ো ঘরের মালী, তারই ঘরে বিয়ে, দেশসুদ্ধ লোক তাকিয়ে আছে।”

নীরজা বললে, “আচ্ছা তোর ভয় নেই, তুই এখন যা।” হলা চলে গেল। নীরজা হঠাৎ পাশ ফিরে বালিশে মাথা রেখে গুমরে উঠে বলে উঠল, “রোশনি, রোশনি, আমি ছোটো হয়ে গেছি, ওই হলা মালীর মতোই হয়েছে আমার মন।”

0 Shares