যোগাযোগ

১৫

বিপ্রদাস নবগোপালকে ডেকে বললে, “নবু, আড়ম্বরে পাল্লা দেবার চেষ্টা– ওটা ইতরের কাজ।”

নবগোপাল বললে, “চতুর্মুখ তাঁর পা ঝাড়া দিয়েই বেশি মানুষ গড়েছেন; চারটে মুখ কেবল বড়ো বড়ো কথা বলবার জন্যেই। সাড়ে পনেরো-আনা লোক যে ইতর, তাদের কাছে সম্মান রাখতে হলে ইতরের রাস্তাই ধরতে হয়।”

বিপ্রদাস বললে, “তাতেও তুমি পেরে উঠবে না। তার চেয়ে সাত্ত্বিকভাবে কাজ করি, সে দেখাবে ভালো। উপযুক্ত ব্রাহ্মণপণ্ডিত আনিয়ে আমাদের সামবেদের মতে বিশুদ্ধভাবে অনুষ্ঠান পালন করব। ওরা রাজা হয়েছে করুক আড়ম্বর; আমরা ব্রাহ্মণ, পুণ্যকর্ম আমাদের।”

নবগোপাল বললে, “দাদা পাঁজি ভুলেছ, এটা সত্যযুগ নয়। জলের নৌকো চালাতে চাও পাঁকের উপর দিয়ে! তোমার প্রজারা আছে– তিনু সরকার আছে তোমার তালুকদার– ভাদু পরামানিক, কমরদ্দি বিশ্বেস, পাঁচু মণ্ডল– এরা কি তোমার ঐ কাঁচকলাভাতে হবিষ্যি-করা বামনাইয়ের এক অক্ষর মানে বুঝবে? এরা কি যাজ্ঞবল্ক্যের প্রপৌত্র? এদের যে বুক ফেটে যাবে। তুমি চুপ করে থাকো, তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না।”

নবগোপাল প্রজাদের সঙ্গে মিলে উঠে-পড়ে লাগল। সবাই বুক ঠুকে বললে, টাকার জন্যে ভাবনা কী? আমলা ফয়লা পাইক বরকন্দাজ সবারই গায়ে চড়ল নতুন লাল বনাতের চাদর, রঙিন ধুতি। সালুতে-মোড়া ঝালর-ঝোলানো নিশেন-ওড়ানো এক নহবতখানা উঠল, সাত ক্রোশ তফাত থেকে তার চুড়ো দেখা যায়। দুই শরিকে মিলে তাদের চার চার হাতি বের করলে, সাজ চড়ল তাদের পিঠে, যখন-তখন বিনা কারণে ঘোষালদিঘির সামনের রাস্তায় শুঁড় দুলিয়ে দুলিয়ে তারা টহলিয়ে বেড়ায়, গলায় ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজতে থাকে। আর যাই হোক, পাটের বস্তা থেকে হাতি বের হয় না, এই বলে সকলেই দুই পা চাপড়ে হো হো করে হেসে নিলে।

অঘ্রানের সাতাশে পড়েছে বিয়ের দিন; এখনো দিনদশেক বাকি। এমন সময় লোকমুখে জানা গেল, রাজা আসছে দলবল নিয়ে। ভাবনা পড়ে গেল, কর্তব্য কী। মধুসূদন এদের কাছে কোনো খবর দেয় নি। বুঝি মনে করেছে ভদ্রতা সাধারণ লোকের, অভদ্রতাই রাজোচিত। এমন অবস্থায় নিজেরা গায়ে পড়ে স্টেশন থেকে ওদের এগিয়ে আনতে যাওয়া কি সংগত হবে? খবর না-দেওয়ার উচিত জবাব হচ্ছে খবর না-নেওয়া।

সবই সত্য, কিন্তু যুক্তির দ্বারা সংসারে দুঃখ ঠেকানো যায় না। কুমুর প্রতি বিপ্রদাসের গভীর স্নেহ; পাছে তাকে কিছুতে আঘাত করে এ কথাটা সকল তর্ক ছাড়িয়ে যায়। মেয়েদের পীড়ন করা এতই সহজ; তাদের মর্মস্থান চার দিকেই অনাবৃত। জবরদস্তের হাতেই সমাজ চাবুক জুগিয়েছে; আর যারা বর্মহীন তাদের স্পর্শকাতর পিঠের দিকে কোনো বিধিবিধান নজর করে না। এমন অবস্থায় স্নেহের ধনকে রোষ-বিদ্বেষ-ঈর্ষার তুফানে ভাসিয়ে দিয়ে নিজের অভিমান বাঁচাবার চেষ্টা করা কাপুরুষতা, বিপ্রদাসের মনের এই ভার।

বিপ্রদাস কাউকে না জানিয়ে ঘোড়ায় চড়ে গেল স্টেশনে। গাড়ি এসে পৌঁছল, তখন বেলা পাঁচটা। সেলুন-গাড়ি থেকে রাজা নামল দলবল নিয়ে। বিপ্রদাসকে দেখে শুষ্ক সংক্ষিপ্ত নমস্কার করে বললে, “এ কী, আপনি কেন কষ্ট করে?”

বিপ্রদাস। বিলক্ষণ! এই প্রথম আসা আমার দেশে, অভ্যর্থনা করে নেবে না?

রাজা। ভুল করছেন। আপনার দেশে এখনো আসি নি। সে হবে বিয়ের দিনে।

বিপ্রদাস কথাটার মানে বুঝতে পারলে না। স্টেশনে ভিড়ের মধ্যে তর্ক করবার জায়গা নয়– তাই কেবল বললে, “ঘাটে বজরা তৈরি।”

রাজা বললে, “দরকার হবে না, আমাদের স্টীমলঞ্চ এসেছে।”

বিপ্রদাস বুঝলে সুবিধে নয়। তবু আর-একবার বললে, “খাওয়া-দাওয়ার জিনিস-পত্র, রসুইয়ের নৌকো সমস্তই প্রস্তুত।”

“কেন এত উৎপাত করলেন! কিছুই দরকার হবে না। দেখুন, একটা কথা মনে রাখবেন, এসেছি আমার পূর্বপুরুষদের জন্মভূমিতে– আপনাদের দেশে না। বিয়ের দিনে সেখানে যাবার কথা।”

বিপ্রদাস বুঝলে কিছুতেই নরম হবার আশা নেই। বুকের ভিতরটা দমে গেল। স্টেশনের বসবার ঘরে কেদারায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। শীতের সন্ধ্যা, অন্ধকার হয়ে এসেছে। উত্তর থেকে গাড়ি আসবার জন্যে ঘণ্টা পড়ল, স্টেশনে আলো জ্বলল– লাগাম ছেড়ে ঘোড়াকে নিজের মরজিমত চলতে দিয়ে বিপ্রদাস যখন বাড়ি ফিরলে তখন যথেষ্ট রাত। কোথায় গিয়েছিল, কী ঘটেছিল, কাউকে কিছুই বললে না।

সেইদিন রাত্রে ওর ঠাণ্ডা লেগে কাশি আরম্ভ হল। ক্রমেই চলল বেড়ে। উপেক্ষা করতে গিয়ে ব্যামোটাকে আরো উস্‌কে তুললে। শেষকালে কুমু ওকে অনেক ধরে কয়ে এনে বিছানায় শোওয়ায়। অনুষ্ঠানের সমস্ত ভারই পড়ল নবগোপালের উপর।

১৬

দুদিন পরেই নবগোপাল এসে বললে, “কী করি একটা পরামর্শ দাও।”

বিপ্রদাস ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কেন? কী হয়েছে?”

“সঙ্গে গোটাকতক সাহেব– দালাল হবে, কিম্বা মদের দোকানের বিলিতি শুঁড়ি– কাল পীরপুরের চরের থেকে কিছু না হবে তো দুশো কাদাখোঁচা পাখি মেরে নিয়ে উপস্থিত। আজ চলেছে চন্দনদহের বিলে। এই শীতের সময় সেখানে হাঁসের মরসুম– রাক্ষুসে ওজনের জীবহত্যা হবে– অহিরাবণ মহীরাবণ হিড়িম্বা ঘটোৎকচ ইস্তিক কুম্ভকর্ণের পর্যন্ত পিণ্ডি দেবার উপযুক্ত, প্রেতলোকে দশমুণ্ড রাবণের চোয়াল ধরে যাবার মতো।”

বিপ্রদাস স্তম্ভিত হয়ে রইল, কিছু বললে না।

0 Shares