যোগাযোগ

নবগোপাল বললে, “তোমারই হুকুম ঐ বিলে কেউ শিকার করতে পারে না। সেবার জেলার ম্যাজিস্ট্রেটকে পর্যন্ত ঠেকিয়েছিলে– আমরা তো ভয় করেছিলুম তোমাকেও পাছে সে রাজহাঁস ভুল করে গুলি করে বসে। লোকটা ছিল ভদ্র, চলে গেল। কিন্তু এরা গো-মৃগ-দ্বিজ কাউকে মানবার মতো মানুষ নয়। তবু যদি বল তো একবার না হয়–”

বিপ্রদাস ব্যস্ত হয়ে বলে, “না না, কিচ্ছু বোলো না।”

বিপ্রদাস বাঘ-শিকারে জেলার মধ্যে সব-সেরা। কোনো-একবার পাখি মেরে তার এমন ধিক্‌কার হয়েছিল যে, সেই অবধি নিজের এলাকায় পাখি মারা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে।

শিয়রের কাছে কুমু বসে বিপ্রদাসের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। নবগোপাল চলে গেলে সে মুখ শক্ত করে বললে, “দাদা, বারণ করে পাঠাও।”

“কী বারণ করব?”

“পাখি মারতে।”

“ওরা ভুল বুঝবে কুমু, সইবে না।”

“তা বুঝুক ভুল। মান-অপমান শুধু ওদের একলার নয়?”

বিপ্রদাস কুমুর মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে হাসলে। সে জানে কঠিন নিষ্ঠার সঙ্গে কুমু মনে মনে সতীধর্ম অনুশীলন করছে। ছায়েবানুগতাস্বচ্ছা। সামান্য পাখির প্রাণ নিয়ে কায়ার সঙ্গে ছায়ার পথভেদ ঘটবে না কি?

বিপ্রদাস স্নেহের স্বরে বললে, “রাগ করিস নে কুমু, আমিও একদিন পাখি মেরেছি। তখন অন্যায় বলে বুঝতেই পারি নি। এদেরও সেই দশা।”

অক্লান্ত উৎসাহের সঙ্গে চলল শিকার, পিকনিক, এবং সন্ধেবেলায় ব্যান্ডের সংগীত-সহযোগে ইংরেজ অভ্যাগতদের নাচ। বিকালে টেনিস, তা ছাড়া দিঘির নৌকোর ‘পরে তিন-চার পর্দা তুলে দিয়ে বাজি রেখে পালের খেলা। তাই দেখতে গ্রামের লোকেরা দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে যায়। রাত্রে ডিনারের পরে চীৎকার চলে, “ফর হী ইজ এ জলি গুড ফেলো।” এই-সব বিলাসের প্রধান নায়কনায়িকা সাহেব-মেম, তাতেই গাঁয়ের লোকের চমক লাগে। এরা যে সোলার চুপি মাথায় ছিপ ফেলে মাছ ধরে, সেও বড়ো অপরূপ দৃশ্য। অন্য পক্ষে লাঠিখেলা কুস্তি নৌকোবাচ যাত্রা শখের র্থিয়েটার এবং চারটে হাতির সমাবেশ এর কাছে লাগে কোথায়?

বিবাহের দুদিন আগে গায়ে হলুদ। দামি গয়না থেকে আরম্ভ করে খেলার পুতুল পর্যন্ত সওগাত যা বরের বাসা থেকে এল তার ঘটা দেখে সকলে আবাক। তার বাহনই বা কত! চাটুজ্যেরা খুব দরাজ হাতেই তাদের বিদায় করলে।

অবশেষে জনসাধারণকে খাওয়ানো নিয়ে বৈবাহিক কুরুক্ষেত্রের দ্রোণপর্ব শুরু হল।

সেদিন ঢোল পিটিয়ে সর্বসাধারণের নিমন্ত্রণ মধুসাগরের তীরে মধুপুরীতে। রবাহূত অনাহূত কারো বাদ নেই। নবগোপাল রেগে আগুন। এ কী আস্পর্ধা! আমরা হলুম জমিদার, এর মধ্যে উনি ওঁর মধুপুরী খাড়া করেন কোথা থেকে?

এ দিকে ভোজের আয়োজনটা খুব ব্যাপকরূপেই সকলের কাছে প্রকাশমান হয়ে উঠল। সামান্য ফলার নয়। মাছ দই ক্ষীর সন্দেশ ঘি ময়দা চিনি খুব শোরগোল করে আমদানি। গাছতলায় মস্ত মস্ত উনন পাতা; রান্নার জন্যে নানা আয়তনের হাঁড়ি হাঁড়া মালসা কলসী জালা; সারবন্দি গোরুর গাড়িতে এল আলু বেগুন কাঁচ-কলা শাকসব্‌জি। আহারটা হবে সন্ধের সময় বাঁধা রোশনাইয়ের আলোয়।

এ দিকে চাটুজ্যেদের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন। দলে দলে প্রজারা মিলে নিজেরাই আয়োজন করেছে। হিন্দুদের মুসলমানদের স্বতন্ত্র জায়গা। মুসলমান প্রজার সংখ্যাই বেশি– রাত না পোয়াতেই তারা নিজেরাই রান্না চড়িয়েছে। আহারের উপকরণ যত না হোক, ঘন ঘন চাটুজ্যেদের জয়ধ্বনি উঠছে তার চতুগুZ। স্বয়ং নবগোপালবাবু বেলা প্রায় পাঁচটা পর্যন্ত অভুক্ত অবস্থায় বসে থেকে সকলকে খাওয়ালেন। তার পরে হল কাঙালিবিদায়। মাতব্বর প্রজারা নিজেরাই দানবিতরণের ব্যবস্থা করলে। কলধ্বনিতে জয়ধ্বনিতে বাতাসে চলল সমুদ্রমন্থন।

মধুপুরীতে সমস্তদিন রান্না বসেছে। গন্ধে বহুদূর পর্যন্ত আমোদিত। খুরি ভাঁড় কলাপাতা হয়েছে পর্বতপ্রমাণ। তরকারি ও মাছ-কোটার আবর্জনা নিয়ে কাকেদের কলরবের বিরাম নেই– রাজ্যের কুকুরগুলোও পরস্পর কামড়াকামড়ি চেঁচামেচি বাধিয়ে দিয়েছে। সময় হয়ে এল, রোশনাই জ্বলছে, মেটিয়াবুরুজের রোশনচৌকি ইমনকল্যাণ থেকে কেদারা পর্যন্ত বাজিয়ে চলল। অনুচর-পরিচরেরা থেকে থেকে উদ্‌বিগ্নমুখে রাজাবাহাদুরের কানের কাছে ফিস্‌ ফিস্‌ করে জানাচ্ছে এখনো খাবার লোক যথেষ্ট এল না। আজ হাটের দিন, ভিন্ন এলেকা থেকে যারা হাট করতে এসেছে তাদের কেউ কেউ পাত-পাড়া দেখে বসে গেছে। কাঙাল-ভিক্ষুকও সামান্য কয়েকজন আছে।

মধুসূদন নির্জন তাঁবুর ভিতর ঢুকে মুখ অন্ধকার করে একটা চাপা হুংকার দিলে–“হুঁ।”

ছোটো ভাই রাধু এসে বললে, “দাদা, আর কেন? চলো।”

“কোথায়?”

“ফিরে যাই কলকাতায়। এরা সব বদমাইশি করছে। এদের চেয়ে বড়ো বড়ো ঘরের পাত্রী তোমার কড়ে আঙুল নাড়ার অপেক্ষায় বসে। একবার তু করলেই হয়।”

মধুসূদন গর্জন করে উঠে বললে, “যা চলে।”

একশো বছর পূর্বে যেমন ঘটেছিল আজও তাই। এবারেও এক পক্ষের আড়ম্বরের চুড়োটা অন্য পক্ষের চেয়ে অনেক উঁচু করেই গড়া হয়েছিল, অন্য পক্ষ তা রাস্তা পার হতে দিলে না। কিন্তু আসল হারজিত বাইরে থেকে দেখা যায় না। তার ক্ষেত্রটা লোকচক্ষুর অগোচরে।

চাটুজ্যেদের প্রজারা খুব হেসে নিলে। বিপ্রদাস রোগশয্যায়; তার কানে কিছুই পৌঁছল না।

১৭

বিয়ের দিন রাজার হুকুম, কনের বাড়ি যাবার পথে ধুমধাম একেবারেই বন্ধ। আলো জ্বলল না, বাজনা বাজল না, সঙ্গে কেবল নিজেদের পুরোহিত, আর দুইজন ভাট। পালকিতে করে নিঃশব্দে বিয়েবাড়িতে বর এল, লোকে হঠাৎ বুঝতেই পারলে না। ও দিকে মধুপুরীর তাঁবুতে আলো জ্বালিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে বিপরীত হৈ হৈ শব্দে বরযাত্রীর দল আহারে আমোদে প্রবৃত্ত। নবগোপাল বুঝলে এটা হল পালটা জবাব। এমন স্থলে কন্যাপক্ষ হাতে পায়ে ধরে বরপক্ষের সাধ্যসাধনা করে; নবগোপাল তার কিছুই করলে না। একবার জিজ্ঞাসাও করলে না, বরযাত্রীদের হল কী।

0 Shares