যোগাযোগ

কুমু চৌকির উপর বসে পড়ল। কান্না পরে হবে, এখন ওর বড়ো দরকার হয়েছে নিজেকে ঠিক করা। ভিতরে ভিতরে সকলের চেয়ে যে-ব্যথাটা ওকে বাজছিল সে হচ্ছে নিজের কাছে নিজের অপমান। এতকাল ধরে ও যা-কিছু সংকল্প করে এসেছে ওর বিদ্রোহী মন সম্পূর্ণ তার উলটো দিকে চলে গেছে। সেই মনটাকে শাসন করবার একটুও সময় পাচ্ছিল না। ঠাকুর, বল দাও, বল দাও, আমার জীবন কালি করে দিয়ো না। আমি তোমার দাসী, আমাকে জয়ী করো, সে জয় তোমারই।

পরিণতবয়সী আঁটসাঁট গড়নের শ্যামবর্ণ একটি সুন্দরী বিধবা ঘরে ঢুকেই, বললে, “মোতির মা তোমাকে একটু ছুটি দিয়েছে সেই ফাঁকে এসেছি; কাউকে তো কাছে ঘেঁষতে দেবে না, বেড়ে রাখবে তোমাকে– যেন সিঁধকাটি নিয়ে বেড়াচ্ছি, ওর বেড়া কেটে তোমাকে চুরি করে নিয়ে যাব। আমি তোমার জা, শ্যামাসুন্দরী; তোমার স্বামী আমার দেওর। আমরা তো ভেবেছিলুম শেষ পর্যন্ত জমাখরচের খাতাই হবে ওর বউ। তা ঐ খাতার মধ্যে জাদু আছে ভাই, এত বয়সে এমন সুন্দরী ঐ খাতার জোরেই জুটল। এখন হজম করতে পারলে হয়। ঐখানে খাতার মন্তর খাটে না। সত্যি করে বলো ভাই, আমাদের বুড়ো দেওরটিকে তোমার পছন্দ হয়েছে তো?”

কুমু অবাক হয়ে রইল, কী জবাব দেবে ভেবেই পেলে না। শ্যামা বলে উঠল, “বুঝেছি, তা পছন্দ না হলেই বা কী, সাত পাক যখন ঘুরেছ তখন একুশ পাক উলটো ঘুরলেও ফাঁস খুলবে না।”

কুমু বললে, “এ কী কথা বলছ দিদি!”

শ্যামা জবাব দিলে, “খোলসা করে কথা বললেই কি দোষ হয় বোন? মুখ দেখে কি বুঝতে পারি নে? তা দোষ দেব না তোমাকে। ও আমাদের আপন বলেই কি চোখের মাথা খেয়ে বসেছি? বড়ো শক্ত হাতে পড়েছ বউ, বুঝে সুঝে চোলো।”

এমন সময় মোতির মাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই বলে উঠল, “ভয় নেই, ভয় নেই, বকুলফুল, যাচ্ছি আমি। ভাবলুম তুমি নেই এই ফাঁকে আমাদের নতুন বউকে একবার দেখে আসি গে। তা সত্যি বটে, এ কৃপণের ধন, সাবধানে রাখতে হবে। সইকে বলছিলুম আমাদের দেওরের এ যেন হল আধ-কপালে মাথাধরা; বউকে ধরেছে ওর বাঁ দিকের পাওয়ার-কপালে, এখন ডান দিকের রাখার-কপালে যদি ধরতে পারে তবেই পুরোপুরি হবে।”

এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে মুহূর্ত পরে ঘরে ঢুকে কুমুর সামনে পানের ডিবে খুলে ধরে বললে, “একটা পান নেও। দোক্তা খাওয়া অভ্যেস আছে?”

কুমু বললে, “না।” তখন এক টিপ দোক্তা নিয়ে নিজের মুখে পুরে দিয়ে শ্যামা মন্দগমনে বিদায় নিলে।

“এখনই বদ্দিমাসিকে খাইয়ে বিদায় করে আসছি, দেরি হবে না” বলে মোতির মা চলে গেল।

শ্যামাসুন্দরী কুমুর মনের মধ্যে ভারি একটা বিস্বাদ জাগিয়ে দিলে। আজকে কুমুর সব চেয়ে দরকার ছিল মায়ার আবরণ, সেইটেই সে আপন মনে গড়তে বসেছিল, আর যে-সৃষ্টিকর্তা দ্যুলোকে ভূলোকে নানা রঙ নিয়ে রূপের লীলা করেন, তাঁকেও সহায় করবার চেষ্টা করছিল, এমন সময় শ্যামা এসে ওর স্বপ্ন-বোনা জালে ঘা মারলে। কুমু চোখ বুজে খুব জোর করে নিজেকে বলতে লাগল, “স্বামীর বয়স বেশি বলে তাঁকে ভালোবাসি নে এ কথা কখনোই সত্য নয়– লজ্জা লজ্জা! এ যে ইতর মেয়েদের মতো কথা!” শিবের সঙ্গে সতীর বিয়ের কথা কি ওর মনে নেই? শিবনিন্দুকরা তাঁর বয়স নিয়ে খোঁটা দিয়েছিল, কিন্তু সে কথা সতী কানে নেন নি।

স্বামীর বয়স বা রূপ নিয়ে এ পর্যন্ত কুমু কোনো চিন্তাই করে নি। সাধারণত যে-ভালোবাসা নিয়ে স্ত্রীপুরুষের বিবাহ সত্য হয়, যার মধ্যে রূপগুণ দেহমন সমস্তই মিলে আছে, তার যে প্রয়োজন আছে এ কথা কুমু ভাবেও নি। পছন্দ করে নেওয়ার কথাটাকেই রঙ মাখিয়ে চাপা দিতে চায়।

এমন সময় ফুলকাটা জামা ও জরির পাড়ওয়ালা ধুতি-পরা ছেলে, বয়স হবে বছর সাতেক, ঘরে ঢুকেই গা ঘেঁষে কুমুর কাছে এসে দাঁড়াল। বড়ো বড়ো স্নিগ্ধ চোখ ওর মুখের দিকে তুলে ভয়ে ভয়ে আস্তে আস্তে মিষ্টি সুরে বললে, “জ্যাঠাইমা।” কুমু তাকে কোলের উপর টেনে নিয়ে বললে, “কী বাবা, তোমার নাম?” ছেলেটি খুব ঘটা করে বললে, শ্রীটুকুও বাদ দিলে না, “শ্রীমোতিলাল ঘোষাল।” সকলের কাছে পরিচয় ওর হাবলু বলে। সেইজন্যেই উপযুক্ত দেশকালপাত্রে নিজের সম্মান রাখবার জন্যে পিতৃদত্ত নামটাকে এত সুসম্পূর্ণ করে বলতে হয়। তখন কুমুর বুকের ভিতরটা টনটন করছিল– এই ছেলেকে বুকে চেপে ধরে যেন বাঁচল। হঠাৎ কেমন মনে হল কতদিন ঠাকুরঘরে যে গোপালকে ফুল দিয়ে এসেছে, এই ছেলেটির মধ্যে সে-ই ওর কোলে এসে বসল। ঠিক যে-সময়ে ডাকছিল সেই দুঃখের সময়েই এসে ওকে বললে, “এই যে আমি তোমার সান্ত্বনা।” মোতির গোল গোল গাল টিপে ধরে কুমু বললে, “গোপাল, ফুল নেবে?”

কুমুর মুখ দিয়ে গোপাল ছাড়া আর কোনো নাম বেরোল না। হঠাৎ নিজের নামান্তরে হাবলুর কিছু বিস্ময় বোধ হল– কিন্তু এমন সুর ওর কানে পৌঁচেছে যে, কিছু আপত্তি ওর মনে আসতে পারে না।

এমন সময়ে পাশের ঘর থেকে মোতির মা ছেলের গলা শুনতে পেয়ে ছুটে এসে বললে, “ঐ রে, বাঁদর-ছেলেটা এসেছে বুঝি।” শ্রীমোতিলাল ঘোষাল-এর সম্মান আর থাকে না। নালিশে-ভরা চোখ তুলে নিঃশব্দে মায়ের মুখের দিকে সে চেয়ে রইল, ডান হাতে জ্যাঠাইমার আঁচল চেপে। কুমু হাবলুকে তার বাঁ হাত দিয়ে বেড়ে নিয়ে বললে, “আহা, থাক্‌-না।”

“না ভাই, অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন শুতে যাক– এ বাড়িতে ওকে খুব সহজেই মিলবে, ওর মতো সস্তা ছেলে আর কেউ নেই।” বলে মোতির মা অনিচ্ছুক ছেলেকে শোয়াবার জন্যে নিয়ে গেল। এই এতটুকুতেই কুমুর মনের ভার গেল হালকা হয়ে। ওর মনে হল প্রার্থনার জবাব পেলুম, জীবনের সমস্যা সহজ হয়ে দেখা দেবে এই ছোটো ছেলেটির মতোই।

0 Shares