যোগাযোগ

কুমু ধীরে ধীরে বললে, “তুমি আমাকে অপমান করতে চাও? হার মানতে হবে। তোমার অপমান মনের মধ্যে নেব না।”

কুমু কাকে এ-সব কথা বলছে? ওর বিস্ফারিত চোখের সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে? মধুসূদন অবাক হয়ে গেল, ভাবলে এ মেয়ে ঝগড়া করে না কেন! এর ভাবখানা কী?

মধুসূদন বক্রোক্তি করে বললে, “তুমি তোমার দাদার চেলা, কিন্তু জেনে রেখো, আমি তোমার সেই দাদার মহাজন, তাকে এক হাটে কিনে আর-এক হাটে বেচতে পারি।”

ও যে কুমুর দাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ এ কথা কুমুর মনে দেগে দেবার জন্যে মূঢ় আর কোনো কথা খুঁজে পেলে না।

কুমু বললে, “দেখো, নিষ্ঠুর হও তো হোয়ো, কিন্তু ছোটো হোয়ো না।” বলে সোফার উপর বসে পড়ল।

কর্কশস্বরে মধুসূদন বলে উঠল, “কী! আমি ছোটো! আর তোমার দাদা আমার চেয়ে বড়ো?”

কুমু বললে, “তোমাকে বড়ো জেনেই তোমার ঘরে এসেছি।”

মধুসূদন ব্যঙ্গ করে বললে, “বড়ো জেনেই এসেছ, না, টাকার লোভে?”

তখন কুমু সোফা থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে খোলা ছাদে মেজের উপর গিয়ে বসল।

কলকাতায় শীতকালের কৃপণ রাত্রি, ধোঁয়ায় কুয়াশায় ঘোলা, আকাশ অপ্রসন্ন, তারার আলো যেন ভাঙা গলার কথার মতো। কুমুর মন তখন অসাড়, কোনো ভাবনা নেই, কোনো বেদনা নেই। একটা ঘন কুয়াশার মধ্যে সে যেন লুপ্ত হয়ে গেছে।

কুমু যে এমন করে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যাবে মধুসূদন এ একেবারে ভাবতেই পারে নি। নিজের এই পরাভবের জন্যে সকলের চেয়ে রাগ হচ্ছে কুমুর দাদার উপর। শোবার ঘরে চৌকির উপরে বসে পড়ে শূন্য আকাশের দিকে সে একটা ঘুষি নিক্ষেপ করলে। খানিকক্ষণ বসে থেকে ধৈর্য আর রাখতে পারলে না। ধড়ফড় করে উঠে ছাদে বেরিয়ে ওর পিছনে গিয়ে ডাকলে, “বড়োবউ!”

কুমু চমকে উঠে পিছন ফিরে দাঁড়ালে।

“ঠাণ্ডায় হিমে বাইরে এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ? চলো ঘরে।”

কুমু অসংকোচে মধুসূদনের মুখের দিকে চেয়ে রইল। মধুসূদনের মধ্যে যেটুকু প্রভুত্বের জোর ছিল তা গেল উড়ে। কুমুর বাঁ হাত ধরে আস্তে আস্তে বললে, “এসো ঘরে।”

কুমুর ডান হাতে তার দাদার আশীর্বাদের সেই টেলিগ্রাম ছিল, সেটা সে বুকে চেপে ধরল। স্বামীর হাত থেকে হাত টেনে নিল না, নীরবে ধীরে ধীরে শোবার ঘরে ফিরে গেল।

২৬

পরদিন ভোরে যখন কুমু বিছানায় উঠে বসেছে তখন ওর স্বামী ঘুমোচ্ছে। কুমু তার মুখের দিকে চাইলে না, পাছে মন বিগড়ে যায়। অতি সাবধানে উঠে পায়ের কাছে প্রণাম করলে, তার পরে স্নান করবার ঘরে গেল। স্নান সারা হলে পর পিছন দিকের দরজা খুলে গিয়ে বসল ছাদে, তখন কুয়াশার ভিতর দিয়ে পূর্ব-আকাশে একটা মলিন সোনার রেখা দেখা দিয়েছে।

বেলা হল, রোদ্‌দুর উঠল যখন, কুমু আস্তে আস্তে শোবার ঘরে ফিরে এসে দেখলে তার স্বামী তখন চলে গেছে। আয়নার দেরাজের উপর তার পুঁতির কাজ-করা থলিটি ছিল। তার মধ্যে দাদার টেলিগ্রামের কাগজটি রাখবার জন্যে সেটা খুলেই দেখতে পেলে সেই নীলার আংটি নেই।

সকালবেলাকার মানসপূজার পর তার মুখে যে একটি শান্তির ভাব এসেছিল সেটা মিলিয়ে গিয়ে চোখে আগুন জ্বলে উঠল! কিছু মিষ্টি ও দুধ খাওয়াবে বলে ডাকতে এল মোতির মা। কুমুর মুখে জবাব নেই, যেন কঠিন পাথরের মূর্তি!

মোতির মা ভয় পেয়ে পাশে এসে বসল– জিজ্ঞাসা করলে, “কী হয়েছে, ভাই?” কুমুর মুখে কথা বেরোল না, ঠোঁট কাঁপতে লাগল।

“বলো দিদি, আমাকে বলো, কোথায় তোমার বেজেছে?”

কুমু রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বললে, “নিয়ে গেছে চুরি করে!”

“কী নিয়ে গেছে দিদি?”

“আমার আংটি– আমার দাদার আশীর্বাদী আংটি।”

“কে নিয়ে গেছে?”

কুমু উঠে দাঁড়িয়ে কারো নাম না করে বাইরের অভিমুখে ইঙ্গিত করলে।

“শান্ত হও ভাই, ঠাট্টা করেছে তোমার সঙ্গে, আবার ফিরিয়ে দেবে।”

“নেব না ফিরিয়ে– দেখব কত অত্যাচার করতে পারে ও!”

“আচ্ছা, সে হবে পরে, এখন মুখে কিছু দেবে এসো।”

“না, পারব না; এখানকার খাবার গলা দিয়ে নামবে না।”

“লক্ষ্মীটি ভাই, আমার খাতিরে খাও।”

“একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, আজ থেকে আমার নিজের বলে কিছুই রইল না?”

“না, রইল না। যা-কিছু রইল তা স্বামীর মর্জির উপরে। জান না, চিঠিতে দাসী বলে দস্তখত করতে হবে?”

দাসী! মনে পড়ল, রঘুবংশের ইন্দুমতীর কথা–

গৃহিণী সচিবঃ সখী মিথঃ

প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ–

ফর্দের মধ্যে দাসী তো কোথাও নেই। সত্যবানের সাবিত্রী কি দাসী? কিম্বা উত্তররামচরিতের সীতা?

কুমু বললে, “স্ত্রী যাদের দাসী তারা কোন্‌ জাতের লোক?”

“ও মানুষকে এখনো চেন নি। ও যে কেবল অন্যকে গোলামি করায় তা নয়, নিজের গোলামি নিজে করে। যেদিন আপিসে যেতে পারে না, নিজের বরাদ্দ থেকে সেদিনকার টাকা কাটা পড়ে। একবার ব্যামো হয়ে এক মাসের বরাদ্দ বন্ধ ছিল, তার পরের দু-তিন মাস খাইখরচ পর্যন্ত কমিয়ে লোকসান পুষিয়ে নিয়েছে। এতদিন আমি ঘরকন্নার কাজ চালিয়ে আসছি সেই অনুসারে আমারও মাসহারা বরাদ্দ। আত্মীয় বলে ও কাউকে মানে না। এ বাড়িতে কর্তা থেকে চাকর-চাকরানী পর্যন্ত সবাই গোলাম।”

কুমু একটু চুপ করে থেকে বললে, “আমি সেই গোলামিই করব। আমার রোজকার খোরপোশ হিসেবমত রোজ রোজ শোধ করব! এ বাড়িতে বিনা মাইনের স্ত্রী-বাঁদী হয়ে থাকব না। চলো আমাকে কাজে ভরতি করে নেবে। ঘরকন্নার ভার তোমার উপরেই তো–আমাকে তুমি তোমার অধীনে খাটিয়ে নিয়ো, আমাকে রানী বলে কেউ যেন ঠাট্টা না করে।”

0 Shares