যোগাযোগ

বাতির ঘর থেকে মধুসূদন বেরিয়ে এসে বারান্দা বেয়ে খানিকটা যেতেই সামনে দেখে শ্যামা। তার হাতে একটি প্রদীপ।

“একি ঠাকুরপো, এখানে কোথা থেকে এলে?”

মধুসূদন তার কোনো উত্তর না করে বললে, “তুমি কোথায় যাচ্ছ বউ?”

“কাল যে আমার ব্রত, ব্রাহ্মণভোজন করাতে হবে তারই জোগাড়ে চলেছি– তোমারও নেমন্তন্ন রইল। কিন্তু তোমাকে দক্ষিণে দেবার মতো শক্তি নেই ভাই।”

মধুসূদনের মুখে একটা জবাব আসছিল, সেটা চেপে গেল।

সেই শেষরাত্রের অন্ধকারে প্রদীপের আলোয় শ্যামাকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। শ্যামা একটু হেসে বললে, “আজ ঘুম থেকে উঠেই তোমার মতো ভাগ্যবান পুরুষের মুখ দেখলুম, আমার দিন ভালোই যাবে। ব্রত সফল হবে।”

ভাগ্যবান শব্দটার উপর একটু জোর দিলে– মধুসূদনের কানে কথাটা বিড়ম্বনার মতো শোনাল। কুমুর সম্বন্ধে কোনো কথা স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করতে শ্যামার সাহস হল না। “কাল কিন্তু আমার ঘরে খেতে এসো, মাথা খাও,” বলে সে চলে গেল।

ঘরে এসে মধুসূদন বিছানায় শুয়ে পড়ল। বাইরে লণ্ঠনটা রাখলে, যদি কুমু আসে। কুমুদিনীর সেই সুপ্ত মুখ কিছুতে মন থেকে নড়তে চায় না; আর কেবলই মনে পড়ে কুমুর অতুলনীয় সেই হাতখানি শালের বাইরে এলিয়ে। বিবাহকালে এই হাত যখন নিজের হাতে নিয়েছিল তখন একে সম্পূর্ণ দেখতে পায় নি– আজ দেখে দেখে চোখের আর আশ মিটতে চায় না। এই হাতের অধিকারটি সে কবে পাবে? বিছানায় আর টিঁকতে পারে না; উঠে পড়ল। আলো জ্বালিয়ে কুমুর ডেস্কের দেরাজ খুললে। দেখলে সেই পুঁতি-গাঁথা থলিটি। প্রথমেই বেরোল বিপ্রদাসের টেলিগ্রামখানি– “ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ করুন”– তার পরে একখানি ফোটোগ্রাফ, ওর দুই দাদার ছবি– আর একখানি কাগজের টুকরো, বিপ্রদাসের হাতে-লেখা গীতার এই শ্লোক–

যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ,

যৎ তপস্যসি, কৌন্তেয়, তৎ কুরুষ মদর্পণম্‌।

ঈর্ষায় মধুসূদনের মন ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল। দাঁতে দাঁতে লাগিয়ে বিপ্রদাসকে মনে মনে লোপ করে দিলে। সেই লুপ্তির দিন একদা আসবে ও নিশ্চয় জানে– অল্প অল্প করে স্ক্রু আঁটতে হবে; কিন্তু কুমুদিনীর যে-উনিশটা বছর মধুসূদনের আয়ত্তের বাইরে, সেইটে বিপ্রদাসের হাত থেকে এই মুহূর্তেই ছিনিয়ে নিতে পারলে তবেই ও মনে শান্তি পায়। আর কোনো রাস্তা জানে না জবরদস্তি ছাড়া। পুঁতির থলিটি আজ সাহস করে ফেলে দিতে পারলে না– যেদিন আংটি হরণ করে নিয়েছিল সেদিন ওর সাহস আরো বেশি ছিল; তখনো জানত কুমুদিনী সাধারণ মেয়েরই মতো সহজেই শাসনের অধীন, এমন-কি, শাসনই পছন্দ করে। আজ বুঝেছে কুমুদিনী যে কী করতে পারে এবং পারে না কিচ্ছু বলবার জো নেই।

কুমুদিনীকে নিজের জীবনের সঙ্গে শক্ত বাঁধনে জড়াবার একটি মাত্র রাস্তা আছে, সে কেবল সন্তানের মায়ের রাস্তা। সেই কল্পনাতেই ওর সান্ত্বনা।

এমনি করে ঘড়িতে পাঁচটা বাজল। কিন্তু শীতরাত্রির অন্ধকার তখনো যায় নি। আর কিছুক্ষণ পরেই আলো উঠবে, আজকের রাত হবে ব্যর্থ। মধুসূদন তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে চলল– ফরাশখানার সামনে পায়ের শব্দটা বেশ একটু স্পষ্টই ধ্বনিত করলে– দরজাটা শব্দ করেই খুললে– দেখলে ভিতরে কুমু নেই। কোথায় সে?

উঠোনের কলে জল-পড়ার শব্দ কানে এল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলে, যত রাজ্যের পুরানো অব্যবহার্য মরচে-পড়া পিলসুজগুলো নিয়ে কুমু তেঁতুল দিয়ে মাজছে। এ কেবল ইচ্ছা করে কাজের ভার বাড়াবার চেষ্টা, শীতের ভোরবেলার নিদ্রাহীন দুঃখকে বিস্তারিত করে তোলা।

মধুসূদন উপরের বারান্দা থেকে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। অবলার বলকে কী করে পরাস্ত করতে হয় এই তার ভাবনা। সকালে উঠে বাড়ির লোকে যখন দেখবে কুমু পিলসুজ মাজছে কী ভাববে! যে চাকরের উপরে মাজাঘষার ভার, সেই বা কী মনে করবে? বিশ্বসুদ্ধ লোকের কাছে তাকে হাস্যাস্পদ করবার এমন তো উপায় আর নেই।

একবার মধুসূদনের মনে হল কলতলায় গিয়ে কুমুর সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেয়। কিন্তু সকালবেলায় সেই উঠানের মাঝখানে দুজনে বচসা করবে আর বাড়িসুদ্ধ লোকে তামাশা দেখতে বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে আসবে এই প্রহসনটা কল্পনা করে পিছিয়ে গেল। মেজো ভাই নবীনকে ডাকিয়ে বললে, “বাড়িতে কী-সব ব্যাপার হচ্ছে চোখ রাখ কি?”

নবীন ছিল বাড়ির ম্যানেজার। সে ভয় পেয়ে বললে, “কেন দাদা, কী হয়েছে?”

নবীন জানে, দাদার যখন রাগ করবার একটা কারণ ঘটে তখন শাসন করবার একটা মানুষ চাই। দোষী যদি ফসকে যায় তো নির্দোষী হলেও চলে– নইলে ডিসিপ্লিন থাকে না, নইলে সংসারে ওর রাষ্ট্রতন্ত্রের প্রেস্‌টিজ চলে যায়।

মধুসূদন বললে, “বড়োবউ যে পাগলের মতো কাণ্ডটা করতে বসেছে, তার কারণটা কী সে কি আমি জানি নে মনে কর?”

বড়োবউ কী পাগলামি করছে সে প্রশ্ন করতে নবীন সাহস করলে না পাছে খবর না-জানাটাই একটা অপরাধ বলে গণ্য হয়।

মধুসূদন বললে, “মেজোবউ ওর মাথা বিগড়োতে বসেছেন সন্দেহ নেই।”

বহু সংকোচে নবীন বলতে চেষ্টা করলে, “না, মেজোবউ তো–”

মধুসূদন বললে, “আমি স্বচক্ষে দেখেছি।”

এর উপরে আর কথা খাটে না। স্বচক্ষে দেখার মধ্যে সেই কাগজচাপার ইতিহাসটা নিহিত ছিল।

২৮

মোতির মা যখনই কুমুকে অকৃত্রিম ভালোবাসার সঙ্গে আদরযত্ন করতে প্রবৃত্ত হয়েছিল তখনই নবীন বুঝেছিল এটা সইবে না; বাড়ির মেয়েরা এই নিয়ে লাগালাগি করবে। নবীন ভাবলে সেই রকমের একটা কিছু ঘটেছে। কিন্তু মধুসূদনের আন্দাজি অভিযোগ সম্বন্ধে প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নেই; তাতে জেদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

0 Shares