যোগাযোগ

ব্যাপারটা কী হয়েছে মধুসূদন তা স্পষ্ট করে বললে না– বোধ করি বলতে লজ্জা করছিল; কী করতে হবে তাও রইল অস্পষ্ট, কেবল ওর মধ্যে যেটুকু স্পষ্ট সে হচ্ছে এই যে, সমস্ত দায়িত্বটা মেজোবউয়েরই, সুতরাং দাম্পত্যের আপেক্ষিক মর্যাদা অনুসারে জবাবদিহির ল্যাজামুড়োর মধ্যে মুড়োর দিকটাই নবীনের ভাগ্যে।

নবীন গিয়ে মোতির মাকে বললে, “একটা ফ্যাসাদ বেধেছে।”

“কেন, কী হয়েছে?”

“সে জানেন অন্তর্যামী, আর দাদা, আর সম্ভবত তুমি; কিন্তু তাড়া আরম্ভ হয়েছে আমার উপরেই।”

“কেন বলো দেখি?”

“যাতে আমার দ্বারা তোমার সংশোধন হয়, আর তোমার দ্বারা সংশোধন হয় ওঁর নতুন ব্যবসায়ের নতুন আমদানির।”

“তা আমার উপরে তোমার সংশোধনের কাজটা শুরু করো– দেখি দাদার চেয়ে তোমার হাতযশ আছে কি না।”

নবীন কাতর হয়ে বললে, “দাদার উড়ে চাকরটা ওঁর দামি ডিনার-সেটের একটা পিরিচ ভেঙেছিল, তার জরিমানার প্রধান অংশ আমাকেই দিতে হয়েছে, জান তো– কেননা জিনিসগুলো আমারই জিম্মে। কিন্তু এবারে যে-জিনিসটা ঘরে এল সেও কি আমারই জিম্মে? তবু জরিমানাটা তোমাতে-আমাতেই বাঁটোয়ারা করে দিতে হবে। অতএব যা করতে হয় করো, আমাকে আর দুঃখ দিয়ো না মেজোবউ।”

“জরিমানা বলতে কী বোঝায় শুনি।”

“রজবপুরে চালান করে দেবেন। মাঝে মাঝে তো সেইরকম ভয় দেখান।”

“ভয় পাও বলেই ভয় দেখান। একবার তো পাঠিয়েছিলেন, আবার রেলভাড়া দিয়ে ফিরিয়ে আনতে হয় নি? তোমার দাদা রেগেও হিসেবে ভুল করেন না। জানেন আমাকে ঘরকন্না থেকে বরখাস্ত করলে সেটা একটুও সস্তা হবে না। আর যদি কোথাও এক পয়সাও লোকসান হয় সে-ঠকা ওঁর সইবে না।”

“বুঝলুম, এখন কী করতে হবে বলো-না।”

“তোমার দাদাকে বোলো, যতবড়ো রাজাই হোন-না, মাইনে করে লোক রেখে রানীর মান ভাঙাতে পারবেন না– মানের বোঝা নিজেকেই মাথায় করে নামাতে হবে। বাসরঘরের ব্যাপারে মুটে ডাকতে বারণ কোরো।”

“মেজোবউ, উপদেশ তাঁকে দেবার জন্যে আমার দরকার হবে না, দুদিন বাদে নিজেরই হুঁশ হবে। ইতিমধ্যে দূতীগিরির কাজটা করো, ফল হোক বা না হোক। দেখাতে পারব নিমক খেয়ে সেটা চুপচাপ হজম করছি নে।”

মোতির মা কুমুকে গেল খুঁজতে। জানত সকালবেলা তাকে পাওয়া যাবে ছাদের উপরে। উঁচু প্রাচীর-দেওয়া ছাদ, তার মাঝে মাঝে ঘুলঘুলি। এলোমেলো গোটাকতক টব, তাতে গাছ নেই। এক কোণে লোহার জাল-দেওয়া একটা বড়ো ভাঙা চৌকো খাঁচা; তার কাঠের তলাটা প্রায় সবটা জীর্ণ। কোনো-এক সময় খরগোশ কিম্বা পায়রা এতে রাখা হত, এখন আচার-আমসত্ত্ব প্রভৃতিকে কাকের চৌর্যবৃত্তি থেকে বাঁচিয়ে রোদ্‌দুরে দেবার কাজে লাগে। এই ছাদ থেকে মাথার উপরকার আকাশ দেখতে পাওয়া যায়, দিগন্ত দেখা যায় না। পশ্চিম-আকাশে একটা লোহার কারখানার চিমনি। যে দুদিন কুমু এই ছাদে বসেছে ঐ চিমনি থেকে উৎসারিত ধূমকুণ্ডলটাই তার একমাত্র দেখবার জিনিস ছিল– সমস্ত আকাশের মধ্যে ঐ কেবল একটি যেন সজীব পদার্থ, কোন্‌ একটা আবেগে ফুলে ফুলে পাক দিয়ে দিয়ে উঠছে।

পিলসুজ প্রভৃতি মাজা সেরে অন্ধকার থাকতেই স্নান করে পুবদিকে মুখ করে কুমু ছাদে এসে বসেছে। ভিজে চুল পিঠের উপর এলিয়ে দেওয়া– সাজসজ্জার কোনো আভাসমাত্র নেই। একখানি মোটা সুতোর সাদা শাড়ি, সরু কালো পাড়, আর শীতনিবারণের জন্য একটা মোটা এণ্ডি-রেশমের ওড়না।

কিছুদিন থেকে প্রত্যাশিত প্রিয়তমের কাল্পনিক আদর্শকে অন্তরের মাঝখানে রেখে এই যুবতী আপন হৃদয়ের ক্ষুধা মেটাতে বসেছিল। তার যত পূজা, যত ব্রত, যত পুরাণকাহিনী, সমস্তই এই কল্পমূর্তিকে সজীব করে রেখেছিল। সে ছিল অভিসারিণী তার মানস-বৃন্দাবনে– ভোরে উঠে সে গান গেয়েছে রামকেলী রাগিণীতে–

হমারে তুমারে সম্প্রীতি লগী হৈ

গুন মনমোহন প্যারে–

যে অনাগত মানুষটির উদ্দেশে উঠছে তার আত্মনিবেদনের অর্ঘ্য, সমুখে এসে পৌঁছবার আগেই সে যেন ওর কাছে প্রতিদিন তার পেয়ালা পাঠিয়ে দিয়েছে। বর্ষার রাত্রে খিড়কির বাগানের গাছগুলি অবিশ্রাম ধারাপতনের আঘাতে আপন পল্লবগুলিকে যখন উতরোল করেছে তখন কানাড়ার সুরে মনে পড়েছে তার ঐ গান–

বাজে ঝননন মেরে পায়েরিয়া

কৈস করো যাউঁ ঘরোয়ারে।

আপন উদাস মনটার পায়ে পায়ে নূপুর বাজছে ঝননন– উদ্দেশহারা পথে বেরিয়ে পড়েছে, কোনোকালে ফিরবে কেমন করে ঘরে! যাকে রূপে দেখবে এমনি করে কতদিন থেকে তাকে সুরে দেখতে পাচ্ছিল। নিগূঢ় আনন্দ-বেদনার পরিপূর্ণতার দিনে যদি মনের মতো কাউকে দৈবাৎ সে কাছে পেত তা হলে অন্তরের সমস্ত গুঞ্জরিত গানগুলি তখনই প্রাণ পেত রূপে। কোনো পথিক ওর দ্বারে এসে দাঁড়াল না। কল্পনার নিভৃত নিকুঞ্জগৃহে ও একেবারেই ছিল একলা। এমন-কি, ওর সমবয়সী সঙ্গিনীও বিশেষ কেউ ছিল না। তাই এতদিন শ্যামসুন্দরের পায়ের কাছে ওর নিরুদ্ধ ভালোবাসা পূজার ফুল-আকারে আপন নিরুদ্দিষ্ট দয়িতের উদ্দেশ খুঁজেছে। সেইজন্যেই ঘটক যখন বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে এল কুমু তখন তার ঠাকুরেরই হুকুম চাইলে– জিজ্ঞাসা করলে, “এইবার তোমাকেই তো পাব?” অপরাজিতার ফুল বললে, “এই তো পেয়েইছ।”

অন্তরের এতদিনের এত আয়োজন ব্যর্থ হল– একেবারে ঠন্‌ করে উঠল পাথরটা, ভরাডুবি হল এক মুহূর্তেই। ব্যথিত যৌবন আজ আবার খুঁজতে বেরিয়েছে, কোথায় দেবে তার ফুল! থালিতে যা ছিল তার অর্ঘ্য, সে যে আজ বিষম বোঝা হয়ে উঠল! তাই আজ এমন করে প্রাণপণে গাইছে, “মেরে গিরিধর গোপাল, ঔর নাহি কোহি।”

0 Shares