যোগাযোগ

“আমি তো চিনি ওঁকে। এবার বোধ হচ্ছে এখানকার বাসায় হাত পড়বে।”

“তা চলোই-না। অত ভাবছ কেন? সেখানে তো জলে পড়বে না?”

“আমাকে চলতে বলছ কিসের জন্যে? এবারে হুকুম হবে মেজোবউকে দেশে পাঠিয়ে দাও।”

“সে হুকুম তুমি মানতে পারবে না জানি।”

“কেমন করে জানলে?”

“আমি কেবল একাই জানি মনে কর, তা নয়– বাড়িসুদ্ধ সবাই তোমাকে স্ত্রৈণ বলে জানে! পুরুষমানুষ যে কী করে স্ত্রৈণ হতে পারে এতদিন তোমার দাদা সে কথা বুঝতেই পারত না। এইবার নিজের বোঝবার পালা এসেছে।”

“বল কী?”

“আমি তো দেখছি তোমাদের বংশে ও রোগটা আছে। এতদিন বড়োভাইয়ের ধাতটা ধরা পড়ে নি। অনেক কাল জমা হয়ে ছিল বলে তার ঝাঁজটা খুব বেশি হবে, দেখে নিয়ো এই আমি বলে দিলাম। যে জোরের সঙ্গে জগৎ-সংসার ভুলে টাকার থলে আঁকড়ে বসেছিল, ঠিক সেই জোরটাই পড়বে বউয়ের উপর।”

“তাই পড়ুক। বড়ো স্ত্রৈণটি আসর জমান কিন্তু মেজো স্ত্রৈণটি বাঁচবে কাকে নিয়ে?”

“সে ভাবনার ভার আমার উপরে। এখন আমি তোমাকে যা বলি তাই করো। ওঁর দেরাজ তোমাকে সন্ধান করতে হবে।”

নবীন হাত জোড় করে বললে, “দোহাই তোমার মেজোবউ– সাপের গর্তে হাত দিতে যদি বলতে আমি দিতুম, কিন্তু দেরাজে না।”

“সাপের গর্তে যদি হাত দিতে হত তবে নিজে দিতুম কিন্তু দেরাজটা সন্ধান তোমাকেই করতে হবে। তুমি তো জান এ বাড়ির সব চিঠিই প্রথমে ওঁকে না দেখিয়ে কাউকে দেবার হুকুম নেই। আমার মন বলছে ওঁর হাতে চিঠি এসেছে।”

“আমারও মন তাই বলছে, কিন্তু সেইসঙ্গে এও বলছে ও চিঠিতে যদি আমি হাত ঠেকাই তা হলে দাদা উপযুক্ত দণ্ড খুঁজেই পাবে না। বোধ হয় সাত বছর সশ্রম ফাঁসির হুকুম হবে।”

“কিছু তোমাকে করতে হবে না, চিঠিতে হাত দিয়ো না, কেবল একবার দেখে এসো দিদির নামে চিঠি আছে কি না।”

মেজোবউয়ের প্রতি নবীনের ভক্তি সুগভীর, এমন-কি নিজেকে তার স্ত্রীর অযোগ্য বলেই মনে করে। সেইজন্যেই তার জন্যে কোনো-একটা দুরূহ কাজ করবার উপলক্ষ জুটলে যতই ভয় করুক সেইসঙ্গে খুশিও হয়।

সেই রাত্রেই নবীনের কাছে মেজোবউ খবর পেল যে, কুমুর নামে একটা চিঠি ও একটা টেলিগ্রাম দেরাজে আছে।

যে উত্তেজনার প্রথম ধাক্কায় কুমু তার শোবার ঘর ছেড়ে দাস্যবৃত্তিতে প্রবৃত্ত হয়েছিল, তার বেগ থেমেছে। অপমানের বিরক্তি কমে এসে বিষাদের ম্লানতায় এখন তার মন ছায়াচ্ছন্ন। বুঝতে পারছে চিরদিনের ব্যবস্থা এ নয়। অথচ সেরকম একটা ব্যবস্থা না হলে কুমু বাঁচবে কী করে? সংসারে আমৃত্যুকাল দিনরাত্রি জোর করে এরকম অসংলগ্নভাবে থাকা তো সম্ভবপর নয়।

এই কথাই সে ভাবছিল তার ঘরের দরজা বন্ধ করে। ঘরটা বারান্দার এক কোণে, কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা। প্রবেশের দ্বার ছাড়া বাকি সমস্ত কুঠরি অবরুদ্ধ। দেয়ালের গায়ে উপর পর্যন্ত কাঠের থাক বসানো। সেই থাকে আলো জ্বালাবার বিচিত্র সরঞ্জাম। তৈলাক্ত মলিনতায় ঘরটা আগাগোড়া ক্লিন্ন। দেয়ালের যে অংশে দরজা সেই দিকে বাতির মোড়ক থেকে কাটা ছবিগুলো এঁটে দিয়ে কোনো-এক ভৃত্য সৌন্দর্যবোধের তৃপ্তিসাধন করেছিল। এক কোণে টিনের বাক্সে আছে গুঁড়ো-করা খড়ি, তার পাশে ঝুড়িতে শুকনো তেঁতুল, এবং কতকগুলো ময়লা ঝাড়ন; আর সারি সারি কেরোসিনের টিন, অধিকাংশই খালি, গুটি দুই-তিন ভরা।

অনিপুণ হস্তে আজ সকাল থেকে কুমু তার কাজে লেগেছিল। ভাঁড়ারের কর্তব্য শেষ করে মোতির মা উঁকি মেরে একবার কুমুর কর্মতপস্যার দুঃসাধ্য সংকটটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে। বুঝতে পারলে দুই-একটা ক্ষণভঙ্গুর জিনিসের অপঘাত আসন্ন। এ বাড়িতে জিনিসপত্রের সামান্য ক্ষুণ্নতাও দৃষ্টি অথবা হিসাব এড়ায় না।

মোতির মা আর থাকতে পারলে না; বললে, “কাজ নেই হাতে, তাই এলুম। ভাবলুম দিদির কাজটাতে একটু হাত লাগাই, পুণ্যি হবে।” এই বলেই কাঁচের গ্লোব ও চিমনির ঝুড়ি নিজের কোলের কাছে টেনে নিয়ে মাজা-মোছায় লেগে গেল।

আপত্তি করতে কুমুর আর তেজ নেই, কেননা ইতিমধ্যে আপন অক্ষমতা সম্বন্ধে আত্ম-আবিষ্কার প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছে। মোতির মার সহায়তা পেয়ে বেঁচে গেল। কিন্তু মোতির মারও অশিক্ষিতপটুত্বের সীমা আছে। কেরোসিন ল্যাম্পে হিসাব করে ফিতে যোজনা তার পক্ষে অসাধ্য। কাজটা হয় তারই তত্ত্বাবধানে, বরাদ্দ অনুসারে তেল প্রভৃতির মাপ তারই স্বহস্তে, কিন্তু হাতে-কলমে সলতে কাটা আজ পর্যন্ত তার দ্বারা হয় নি। তাই অগত্যা বুড়ো বঙ্কু ফরাশকে সহযোগিতার জন্যে ডাকবার প্রস্তাব তুললে।

হার মানতে হল। বঙ্কু ফরাশ এল, এবং দ্রুতহস্তে অল্পকালের মধ্যেই কাজ সমাধা করে দিলে। সন্ধ্যার পূর্বেই দীপগুলো ঘরে ঘরে ভাগ করে দিয়ে আসতে হয়। সেই কাজের জন্যে পূর্বনিয়মমত তাকে যথাসময়ে আসতে হবে কি না বঙ্কু জিজ্ঞাসা করলে। লোকটা সরল প্রকৃতির বটে কিন্তু তবু প্রশ্নের মধ্যে একটু শ্লেষ ছিল-বা। কুমুর কানের ডগা লাল হয়ে উঠল।

সে কোনো জবাব করবার আগেই মোতির মা বললে, “আসবি না তো কী?” কুমুর বুঝতে একটুও বাকি রইল না যে, কাজ করতে গিয়ে কেবল সে কাজের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।

৩১

দুপুরবেলা আহারের পর দরজা বন্ধ করে কুমু বসে পণ করতে লাগল, মনের মধ্যে কিছুতে সে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠতে দেবে না। কুমু বললে, “আজকের দিনটা লাগবে মনকে স্থির করে নিতে; ঠাকুরের আশীর্বাদ নিয়ে কাল সকাল থেকে সংসারধর্মের সত্যপথে প্রবৃত্ত হব।” মধ্যাহ্নে আহারের পর তার কাঠের ঘরে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে চলল নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া। এই কাজে সব চেয়ে সহায় ছিল তার দাদার স্মৃতি। সে যে দেখেছে তার দাদার ধৈর্যের আশ্চর্য গভীরতা; তাঁর মুখে সেই বিষাদ, যেটি তাঁর অন্তরের মহত্ত্বের ছায়া– তার সেই দাদা, তখনকার কালে শিক্ষিতসমাজে প্রচলিত পজিটিভিজ্‌ম্‌ যাঁর ধর্ম ছিল, দেবতাকে বাইরে থেকে প্রণাম করে যাঁর অভ্যাস ছিল না, অথচ দেবতা আপনিই যাঁর জীবন পূর্ণ করে আবির্ভূত।

0 Shares