যোগাযোগ

তাড়াতাড়ি মধুসূদন বাইরে চলে গেল। তার পরেই সেই চিঠির ব্যাপার।

পালের নৌকায় হঠাৎ পাল ফেটে গেলে তার যে দশা মধুসূদনের তাই হল। তখন আর দেরি করবার লেশমাত্র অবকাশ ছিল না। আপিসে চলে গেল। কিন্তু সকল কাজের ভিতরে ভিতরে তার অসম্পূর্ণ ভাঙা চিন্তার তীক্ষ্ণ ধারগুলো কেবলই যেন ঠেলে ঠেলে বিঁধে বিঁধে উঠছে। এই মানসিক ভূমিকম্পের মধ্যে মনোযোগ দিয়ে কাজ করা সেদিন তার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। আপিসে জানিয়ে দিলে উৎকট মাথা ধরেছে, কার্যশেষের অনেক আগেই বাড়ি ফিরে এল।

৩৫

এ দিকে নবীন ও মোতির মা বুঝেছে এবারে ভিত গেল ভেঙে, পালিয়ে বাঁচবার আশ্রয় তাদের আর কোথাও রইল না। মোতির মা বললে, “এখানে যেরকম খেটে খাচ্ছি সেরকম খেটে খাবার জায়গা সংসারে আমার মিলবে। আমার দুঃখ এই যে, আমি গেলে এ বাড়িতে দিদিকে দেখবার লোক আর কেউ থাকবে না।”

নবীন বললে, “দেখো মেজোবউ, এ সংসারে অনেক লাঞ্ছনা পেয়েছি, এ বাড়ির অন্নজলে অনেকবার আমার অরুচি হয়েছে। কিন্তু এইবার অসহ্য হচ্ছে যে, এমন বউ ঘরে পেয়েও কী করে তাকে নিতে হয়, রাখতে হয়, তা দাদা বুঝলে না– সমস্ত নষ্ট করে দিলে। ভালো জিনিসের ভাঙা টুকরো দিয়েই অলক্ষ্মী বাসা বাঁধে।”

মোতির মা বললে, “সে কথা তোমার দাদার বুঝতে দেরি হবে না। কিন্তু তখন ভাঙা আর জোড়া লাগবে না।”

নবীন বললে, “লক্ষ্মণ-দেওর হবার ভাগ্য আমার ঘটল না, এইটেই আমার মনে বাজছে। যা হোক, তুমি জিনিসপত্তর এখনই গুছিয়ে ফেলো, এ বাড়িতে যখন সময় আসে তখন আর তর সয় না।”

মোতির মা চলে গেল। নবীন আর থাকতে পারলে না, আস্তে আস্তে তার বউদিদির ঘরের বাইরে এসে দেখলে, কুমু তার শোবার ঘরের মেজের বিছানার উপর পড়ে আছে। যে চিঠিখানা ছিঁড়ে ফেলেছে তার বেদনা কিছুতেই মন থেকে যাচ্ছে না।

নবীনকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসল। নবীন বললে, “বউদিদি, প্রণাম করতে এসেছি, একটু পায়ের ধুলো দাও।”

বউদিদির সঙ্গে নবীদের এই প্রথম কথাবার্তা।

কুমু বললে, “এসো, বোসো।”

নবীন মাটিতে বসে বললে, “তোমাকে সেবা করতে পারব এই খুশিতে বুক ভরে উঠেছিল। কিন্তু নবীনের কপালে এতটা সৌভাগ্য সইবে কেন? ক-টা দিন মাত্র তোমাকে পেয়েছি, কিছুই করতে পারি নি, এই আপসোস মনে রয়ে গেল।”

কুমু জিজ্ঞাসা করলে, “কোথায় যাচ্ছ তোমরা?”

নবীন বললে, “দাদা আমাদের দেশেই পাঠাবে। এর পরে তোমার সঙ্গে বোধ হয় আর দেখা হবার সুবিধা হবে না, তাই প্রণাম করে বিদায় নিতে এসেছি।” বলে যেই সে প্রণাম করলে মোতির মা ছুটে এসে বললে, “শীঘ্র চলে এসো। কর্তা তোমার খোঁজ করছেন।”

নবীন তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেল। মোতির মাও গেল তার সঙ্গে।

সেই বাইরের ঘরে দাদা তার ডেস্কের কাছে বসে; নবীন এসে দাঁড়াল। অন্যদিনে এমন অবস্থায় তার মুখে যেরকম আশঙ্কার ভাব থাকত আজ তা কিছুই নেই।

মধুসূদন জিজ্ঞাসা করলে, “ডেস্কের চিঠির কথা বড়োবউকে কে বললে?”

নবীন বললে, “আমিই বলেছি।”

“হঠাৎ তোমার এত সাহস বেড়ে উঠল কোথা থেকে?”

“বড়োবউরানী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর দাদার চিঠি এসেছে কি না। এ বাড়ির চিঠি তো তোমার কাছে এসে প্রথমটা ঐ ডেস্কেই জমা হয়, তাই আমি দেখতে এসেছিলুম।”

“আমাকে জিজ্ঞাসা করতে সবুর সয় নি?”

“তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তাই–”

“তাই আমার হুকুম উড়িয়ে দিতে হবে?”

“তিনি তো এ বাড়ির কর্ত্রী, কেমন করে জানব তাঁর হুকুম এখানে চলবে না? তিনি যা বলবেন আমি তা মানব না এতবড়ো আস্পর্ধা আমার নেই। এই আমি তোমার কাছে বলছি, তিনি তো শুধু আমার মনিব নন তিনি আমার গুরুজন, তাঁকে যে মানব সে নিমক খেয়ে নয়, সে আমার ভক্তি থেকে।”

“নবীন, তোমাকে তো এতটুকু বেলা থেকে দেখছি, এ-সব বুদ্ধি তোমার নয়। জানি তোমার বুদ্ধি কে জোগায়। যাই হোক, আজ আর সময় নেই, কাল সকালের ট্রেনে তোমাদের দেশে যেতে হবে।”

“যে আজ্ঞে” বলেই নবীন দ্বিরুক্তি না করেই দ্রুত চলে গেল।

এত সংক্ষেপে “যে আজ্ঞে” মধুসূদনের একটুও ভালো লাগল না। নবীনের কান্নাকাটি করা উচিত ছিল; যদিও তাতে মধুসূদনের সংকল্পের ব্যত্যয় হত না। নবীনকে আবার ফিরে ডেকে বললে, “মাইনে চুকিয়ে নিয়ে যাও, কিন্তু এখন থেকে তোমাদের খরচপত্র জোগাতে পারব না।”

নবীন বললে, “তা জানি, দেশে আমার অংশে যে জমি আছে তাই আমি চাষ করে খাব।”

বলেই অন্য কোনো কথার অপেক্ষা না করেই সে চলে গেল।

মানুষের প্রকৃতি নানা বিরুদ্ধ ধাতু মিশোল করে তৈরি, তার একটা প্রমাণ এই যে, মধুসূদন নবীনকে গভীরভাবে স্নেহ করে। তার অন্য দুই ভাই রজবপুরে বিষয়সম্পত্তির কাজ নিয়ে পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছে, মধুসূদন তাদের বড়ো একটা খোঁজ রাখে না। পিতার মৃত্যুর পর নবীনকে মধুসূদন কলকাতায় আনিয়ে পড়াশুনো করিয়েছে এবং তাকে বরাবর রেখেছে নিজের কাছে। সংসারের কাজে নবীনের স্বাভাবিক পটুতা। তার কারণ সে খুব খাঁটি। আর একটা হচ্ছে, তার কথাবার্তায় ব্যবহারে সকলেই তাকে ভালোবাসে। এ বাড়িতে যখন কোনো ঝগড়াঝাঁটি বাধে তখন নবীন সেটাকে সহজে মিটিয়ে দিতে পারে। নবীন সব কথায় হাসতে জানে, আর লোকদের শুধু কেবল সুবিচার করে না, এমন ব্যবহার করে যাতে প্রত্যেকেই মনে করে তারই ‘পরে বুঝি ওর বিশেষ পক্ষপাত।

নবীনকে মধুসূদন যে মনের সঙ্গে স্নেহ করে তার একটা প্রমাণ, মোতির মাকে মধুসূদন দেখতে পারে না। যার প্রতি ওর মমতা তার প্রতি ওর একাধিপত্য চাই। সেই কারণে মধুসূদন কেবল কল্পনা করে মোতির মা যেন নবীনের মন ভাঙাতেই আছে। ছোটো ভাইয়ের প্রতি ওর যে পৈত্রিক অধিকার, বাইরে থেকে এক মেয়ে এসে সেটাতে কেবলই বাধা ঘটায়। নবীনকে মধুসূদন যদি বিশেষ ভালো না বাসত তা হলে অনেক দিন আগেই মোতির মার নির্বাসনদণ্ড পাকা হত।

0 Shares