যোগাযোগ

মধুসূদন ভেবেছিল এইটুকু কাজ সেরেই আবার একবার আপিসে চলে যাবে। কিন্তু কোনোমতেই মনের মধ্যে জোর পেলে না। কুমু সেই-যে চিঠিখানা ছিঁড়ে দিয়ে চলে গেল সেই ছবিটি তার মনে গভীর করে আঁকা হয়ে গেছে। সে এক আশ্চর্য ছবি, এমনতরো কিছু সে কখনো মনে করতে পারত না। একবার তার চিরকালের সন্দেহ-করা স্বভাববশত মধুসূদন ভেবেছিল নিশ্চয়ই কুমু চিঠিখানা আগেই পড়ে নিয়েছে, কিন্তু কুমুর মুখে এমন একটি নির্মল সত্যের দীপ্তি আছে যে, বেশিক্ষণ তাকে অবিশ্বাস করা মধুসূদনের পক্ষেও অসম্ভব।

কুমুকে কঠিনভাবে শাসন করবার শক্তি মধুসূদন দেখতে দেখতে হারিয়ে ফেলেছে, এখন তার নিজের তরফে যে-সব অপূর্ণতা তাই তাকে পীড়া দিতে আরম্ভ করেছে। তার বয়স বেশি এ কথা আজ সে ভুলতে পারছে না। এমন-কি, তার যে চুলে পাক ধরেছে সেটা সে কোনোমতে গোপন করতে পারলে বাঁচে। তার রঙটা কালো, বিধাতার সেই অবিচার এতকাল পরে তাকে তীব্র করে বাজছে। কুমুর মনটা কেবলই তার মুষ্টি থেকে ফসকে যাচ্ছে, তার কারণ মধুসূদনের রূপ ও যৌবনের অভাব, এতে তার সন্দেহ নেই। এইখানেই সে নিরস্ত্র, সে দুর্বল। চাটুজ্যেদের ঘরের মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু সে যে এমন মেয়ে পাবে বিধাতা আগে থাকতেই যার কাছে তার হার মানিয়ে রেখে দিয়েছেন, এ সে মনেও করে নি। অথচ এ কথা বলবারও জোর মনে নেই যে তার ভাগ্যে একজন সাধারণ মেয়ে হলেই ভালো হত, যার উপরে তার শাসন খাটত।

মধুসূদন কেবল একটা বিষয়ে টেক্কা দিতে পারে! সে তার ধনে। তাই আজ সকালেই ঘরে জহরি এসেছিল। তার কাছ থেকে তিনটে আংটি নিয়ে রেখেছে, দেখতে চায় কোন্‌টাতে কুমুর পছন্দ। সেই আংটির কৌটা তিনটি পকেটে নিয়ে সে তার শোবার ঘরে গেল। একটা চুনি, একটা পান্না, একটা হীরের আংটি। মধুসূদন মনে মনে একটি দৃশ্য কল্পনাযোগে দেখতে পাচ্ছে। প্রথমে সে যেন চুনির আংটির কৌটা অতি ধীরে ধীরে খুললে, কুমুর লুব্ধ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার পরে বেরোল পান্না, তাতে চক্ষু আরো প্রসারিত। তার পর হীরে, তার বহুমূল্য উজ্জ্বলতায় রমণীর বিস্ময়ের সীমা নেই। মধুসূদন রাজকীয় গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললে, “তোমার যেটা ইচ্ছে পছন্দ করে নাও।” হীরেটাই কুমু যখন পছন্দ করলে তখন তার লুব্ধতার ক্ষীণ সাহস দেখে ঈষৎ হাস্য করে মধুসূদন তিনটে আংটিই কুমুর তিন আঙুলে পরিয়ে দিলে। তার পরেই রাত্রে শয়নমঞ্চের যবনিকা উঠল।

মধুসূদনের অভিপ্রায় ছিল এই ব্যাপারটা আজ রাত্রের আহারের পরে হবে। কিন্তু দুপুরবেলাকার দুর্যোগের পর মধুসূদন আর সবুর করতে পারলে না। রাত্রের ভূমিকাটা আজ অপরাহ্নে সেরে নেবার জন্যে অন্তঃপুরে গেল।

গিয়ে দেখে কুমু একটা টিনের তোরঙ্গ খুলে শোবার ঘরের মেজেতে বসে গোছাচ্ছে। পাশে জিনিসপত্র কাপড়চোপড় ছড়ানো।

“এ কী কাণ্ড! কোথাও যাচ্ছ নাকি?”

“হাঁ।”

“কোথায়?”

“রজবপুরে।”

“তার মানে কী হল?”

“তোমার দেরাজ খোলা নিয়ে ঠাকুরপোদের শাস্তি দিয়েছ। সে শাস্তি আমারই পাওনা।”

“যেয়ো না” বলে অনুরোধ করতে বসা একেবারেই মধুসূদনের স্বভাববিরুদ্ধ। তার মনটা প্রথমেই বলে উঠল– যাক-না দেখি কতদিন থাকতে পারে। এক মুহূর্ত দেরি না করে হন্‌ হন্‌ করে ফিরে চলে গেল।

৩৬

মধুসূদন বাইরে গিয়ে নবীনকে ডেকে পাঠিয়ে বললে, “বড়োবউকে তোরা খেপিয়েছিস।”

“দাদা, কালই তো আমরা যাচ্ছি, তোমার কাছে ভয়ে ভয়ে ঢোঁক গিলে কথা কব না। আমি আজ এই স্পষ্ট বলে যাচ্ছি, বড়োবউরানীকে খেপাবার জন্যে সংসারে আর কারো দরকার হবে না– তুমি একাই পারবে। আমরা থাকলে তবু যদি-বা কিছু ঠাণ্ডা রাখতে পারতুম, কিন্তু সে তোমার সইল না।”

মধুসূদন গর্জন করে উঠে বললে, “জ্যাঠামি করিস নে। রজবপুরে যাবার কথা তোরাই ওকে শিখিয়েছিস।”

“এ কথা ভাবতেই পারি নে তো শেখাব কি?”

“দেখ্‌, এই নিয়ে যদি ওকে নাচাস তোদের ভালো হবে না স্পষ্টই বলে দিচ্ছি।”

“দাদা, এ-সব কথা বলছ কাকে? যেখানে বললে কাজে লাগে বলো গে।”

“তোরা কিছু বলিস নি?”

“এই তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, কল্পনাও করি নি।”

“বড়োবউ যদি জেদ ধরে বসে তা হলে কী করবি তোরা?”

“তোমাকে ডেকে আনব। তোমার পাইক বরকন্দাজ পেয়াদা আছে, তুমি ঠেকাতে পার। তার পরে তোমার শত্রুপক্ষেরা এই যুদ্ধের সংবাদ যদি কাগজে রটায় তা হলে মেজোবউকে সন্দেহ করে বোসো না।”

মধুসূদন আবার তাকে ধমক দিয়ে বললে, “চুপ কর্‌! বড়োবউ যদি রজবপুরে যেতে চায় তো যাক, আমি ঠেকাব না।”

“আমরা তাঁকে খাওয়াব কী করে?”

“তোমার স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে। যা, যা বলছি! বেরো বলছি ঘর থেকে।”

নবীন বেরিয়ে গেল। মধুসূদন ওডিকলোন-ভিজনো পটি কপালে জড়িয়ে আবার একবার আপিসে যাবার সংকল্প মনে দৃঢ় করতে লাগল।

নবীনের কাছে মোতির মা সব কথা শুনে দৌড়ে গেল কুমুর শোবার ঘরে। দেখলে তখনো সে কাপড়-চোপড় পাট করছে তোলবার জন্যে। বললে, “এ কী করছ বউরানী?”

“তোমাদের সঙ্গে যাব।”

“তোমাকে নিয়ে যাবার সাধ্য কী আমার!”

“কেন?”

“বড়োঠাকুর তা হলে আমাদের মুখ দেখবেন না।”

“তা হলে আমারও দেখবেন না।”

“তা সে যেন হল, আমরা যে বড়ো গরিব।”

“আমিও কম গরিব না, আমারও চলে যাবে।”

“লোকে যে বড়োঠাকুরকে নিয়ে হাসবে।”

“তা বলে আমার জন্যে তোমরা শাস্তি পাবে এ আমি সইব না।”

0 Shares