যোগাযোগ

“কিন্তু দিদি, তোমার জন্যে তো শাস্তি নয়, এ আমাদের নিজের পাপের জন্যেই।”

“কিসের পাপ তোমাদের?”

“আমরাই তো খবর দিয়েছি তোমাকে।”

“আমি যদি খবর জানতে চাই তা হলে খবর দেওয়াটা অপরাধ?”

“কর্তাকে না জানিয়ে দেওয়াটা অপরাধ।”

“তাই ভালো, অপরাধ তোমরাও করেছ আমিও করেছি। একসঙ্গেই ফল ভোগ করব।”

“আচ্ছা বেশ, তা হলে বলে দেব তোমার জন্যে পালকি। বড়োঠাকুরের হুকুম হয়েছে তোমাকে বাধা দেওয়া হবে না। এখন তবে তোমার জিনিসগুলি গুছিয়ে দিই। ওগুলো নিয়ে যে ঘেমে উঠলে!”

দুজনে গোছাতে লেগে গেল।

এমন সময়ে কানে এল বাইরে জুতোর মচ্‌ মচ্‌ ধ্বনি। মোতির মা দিল দৌড়।

মধুসূদন ঘরে ঢুকেই বললে, “বড়োবউ, তুমি যেতে পারবে না।”

“কেন যেতে পারব না?”

“আমি হুকুম করছি বলে।”

“আচ্ছা, তা হলে যাব না। তার পরে আর কী হুকুম বলো।”

“বন্ধ করো তোমার জিনিস প্যাক করা।”

“এই বন্ধ করলুম।” বলে কুমু উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মধুসূদন বললে, “শোনো, শোনো।”

তখনই কুমু ফিরে এসে বললে,”কী বলো।”

বিশেষ কিছুই বলবার ছিল না। তবু একটু ভেবে বললে, “তোমার জন্যে আংটি এনেছি।”

“আমার যে-আংটির দরকার ছিল সে তুমি পরতে বারণ করেছ, আর আমার আংটির দরকার নেই।”

“একবার দেখোই না চেয়ে।”

মধুসূদন একে একে কৌটো খুলে দেখালে। কুমু একটি কথাও বললে না।

“এর যেটা তোমার পছন্দ সেইটেই তুমি পরতে পারো।”

“তুমি যেটা হুকুম করবে সেইটেই পরব।”

“আমি তো মনে করি তিনটেই তিন আঙুলে মানাবে।”

“হুকুম কর তিনটেই পরব।”

“আমি পরিয়ে দিই।”

“দাও পরিয়ে।”

মধুসূদন পরিয়ে দিলে। কুমু বললে, “আর-কিছু হুকুম আছে?”

“বড়োবউ, রাগ করছ কেন?”

“আমি একটুও রাগ করছি নে।” বলে কুমু আবার ঘর থেকে চলে গেল।

মধুসূদন অস্থির হয়ে বলে উঠল, “আহা, যাও কোথায়? শোনো শোনো।”

কুমু তখনই ফিরে এসে বললে, “কী বলো।”

ভেবে পেলে না কী বলবে। মধুসূদনের মুখ লাল হয়ে উঠল। ধিক্‌কার দিয়ে বলে উঠল, “আচ্ছা যাও।” রেগে বললে, “দাও, আংটিগুলো ফিরিয়ে দাও।”

তখনই কুমু তিনটে আংটি খুলে টিপায়ের উপর রাখলে।

মধুসূদন ধমক দিয়ে বললে, “যাও চলে।”

কুমু তখনই চলে গেল।

এইবার মধুসূদন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলে যে, সে আপিসে যাবেই। তখন কাজের সময় প্রায় উত্তীর্ণ। ইংরেজ কর্মচারীরা সকলেই চলে গেছে টেনিস খেলায়। উচ্চতন বড়োবাবুদের দল উঠি-উঠি করছে। এমন সময় মধুসূদন আপিসে উপস্থিত হয়ে একেবারে খুব কষে কাজে লেগে গেল। ছটা বাজল, সাতটা বাজল, আটটা বাজে, তখন খাতাপত্র বন্ধ করে উঠে পড়ল।

৩৭

এতদিন মধুসূদনের জীবনযাত্রায় কখনো কোনো খেই ছিঁড়ে যেত না। প্রতিদিনের প্রতি মুহূর্তই নিশ্চিত নিয়মে বাঁধা ছিল। আজ হঠাৎ একটা অনিশ্চিত এসে সব গোলমাল বাধিয়ে দিয়েছে। এই-যে আজ আপিস থেকে বাড়ির দিকে চলেছে, রাত্তিরটা যে ঠিক কী ভাবে প্রকাশ পাবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। মধুসূদন ভয়ে ভয়ে বাড়িতে এল, আস্তে আস্তে আহার করলে। আহার করে তখনই সাহস হল না শোবার ঘরে যেতে। প্রথমে কিছুক্ষণ বাইরের দক্ষিণের বারান্দায় পায়চারি করে বেড়াতে লাগল। শোবার সময় ন-টা বাজল তখন গেল অন্তঃপুরে। আজ ছিল দৃঢ় পণ– যথাসময়ে বিছানায় শোবে, কিছুতেই অন্যথা হবে না। শূন্য শোবার ঘরে ঢুকেই মশারি খুলেই একেবারে ঝপ্‌ করে বিছানার উপরে পড়ল। ঘুম আসতে চায় না। রাত্রি যতই নিবিড় হয় ততই ভিতরকার উপবাসী জীবটা অন্ধকারে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। তখন তাকে তাড়া করবার কেউ নেই, পাহারাওয়ালারা সকলেই ক্লান্ত।

ঘড়িতে একটা বাজল, চোখে একটুও ঘুম নেই; আর থাকতে পারল না, বিছানা থেকে উঠে ভাবতে লাগল কুমু কোথায়? বঙ্কু ফরাশের উপর কড়া হুকুম, ফরাশখানা তালাচাবি দিয়ে বন্ধ। ছাদ ঘুরে এল, কেউ নেই। পায়ের জুতো খুলে ফেলে নীচের তলায় বারান্দা বেয়ে ধীরে ধীরে চলতে লাগল। মোতির মার ঘরের সামনে এসে মনে হল যেন কথার্বাতার শব্দ। হতে পারে, কাল চলে যাবে, আজ স্বামীস্ত্রীতে পরামর্শ চলছে। বাইরে চুপ করে দরজায় কান পেতে রইল। দুজনে গুন্‌ গুন্‌ করে আলাপ চলছে। কথা শোনা যায় না, কিন্তু স্পষ্টই বোঝা গেল দুটিই মেয়ের গলা। তবে তো বিচ্ছেদের পূর্বরাত্রে মোতির মায়ের সঙ্গে কুমুরই মনের কথা হচ্ছে। রাগে ক্ষোভে ইচ্ছে করতে লাগল লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলে একটা কাণ্ড করে। কিন্তু নবীনটা তা হলে কোথায়? নিশ্চয়ই বাইরে।

অন্তঃপুর থেকে বাইরে যাবার ঝিলমিল-দেওয়া রাস্তাটাতে লণ্ঠনে একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে, সেইখানে এসেই মধুসূদন দেখলে একখানা লাল শাল গায়ে জড়িয়ে শ্যামা দাঁড়িয়ে। তার কাছে লজ্জিত হয়ে মধুসূদন রেগে উঠল। বললে, “কী করছ এত রাত্রে এখানে?”

শ্যামা উত্তর করলে, “শুয়েছিলুম। বাইরে পায়ের শব্দ শুনে ভয় হল, ভাবলুম বুঝি–”

মধুসূদন তর্জন করে বলে উঠল, “আস্পর্ধা বাড়ছে দেখছি। আমার সঙ্গে চালাকি করতে চেয়ো না, সাবধান করে দিচ্ছি। যাও শুতে।”

শ্যামাসুন্দরী কয়দিন থেকে একটু একটু করে তার সাহসের ক্ষেত্র বাড়িয়ে বাড়িয়ে চলছিল। আজ বুঝলে, অসময়ে অজায়গায় পা পড়েছে। অত্যন্ত করুণ মুখ করে একবার সে মধুসূদনের দিকে চাইলে, তার পরে মুখ ফিরিয়ে আঁচলটা টেনে চোখ মুছলে। চলে যাবার উপক্রম করে আবার সে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, “চালাকি করব না ঠাকুরপো। যা দেখতে পাচ্ছি তাতে চোখে ঘুম আসে না। আমরা তো আজ আসি নি, কতকালের সম্বন্ধ, আমরা সইব কী করে?” বলে শ্যামা দ্রুতপদে চলে গেল।

0 Shares