কুমু বললে, “আজ থাক্– গোপালকে আমার কাছে একবার পাঠিয়ে দাও।”
একটা কালো কঠোর ক্ষুধিত জরা বাহির থেকে কুমুকে গ্রাস করছে রাহুর মতো। যে পরিণত বয়স শান্ত স্নিগ্ধ শুভ্র সুগম্ভীর, এ তো তা নয়; যা লালায়িত, যার সংযমের শক্তি শিথিল, যার প্রেম বিষয়াসক্তিরই স্বজাতীয়, তারই স্বেদাক্ত স্পর্শে কুমুর এত বিতৃষ্ণা। ওর স্বামীর বয়স বেশি বলে কুমুর কোনো আক্ষেপ ছিল না, কিন্তু সেই বয়স নিজের মর্যাদা ভুলেছে বলে তার এত পীড়া। সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন একটা ফলের মতো, আলো-হাওয়ায় মুক্তির মধ্যে সে পাকে, কাঁচা ফলকে জাঁতায় পিষলেই তো পাকে না। সময় পেল না বলেই আজ ওদের সম্বন্ধ কুমুকে এমন করে মারছে, এত অপমান করছে। কোথায় পালাবে! মোতির মাকে ঐ যে বললে, গোপালকে ডেকে দাও, সে এই পালাবার পথ খোঁজা– বৃদ্ধ অশুচিতার কাছ থেকে নবীন নির্মলতার মধ্যে, দূষিত নিশ্বাসবাষ্প থেকে ফুলের বাগানের হাওয়ায়।
একটা পাতলা তুলো-ভরা ছিটের জামা গায়ে দিয়ে হাবলু সিঁড়ির দরজার কাছে এসে ভয়ে ভয়ে দাঁড়াল। ওর মায়ের মতোই বড়ো বড়ো কালো চোখ, তেমনিই জলভরা মেঘের মতো সরস শামলা রঙ, গাল দুটো ফুলো ফুলো, প্রায় ন্যাড়া করে চুল ছাঁটা।
কুমু উঠে গিয়ে সংকুচিত হাবলুকে টেনে এনে বুকে চেপে ধরলে; বললে “দুষ্টু ছেলে, এ দুদিন আস নি কেন?”
হাবলু কুমুর গলা জড়িয়ে ধরে কানে কানে বললে, “জ্যাঠাইমা, তোমার জন্যে কী এনেছি বলো দেখি?”
কুমু তার গালে চুমু খেয়ে বললে, “মানিক এনেছ গোপাল।”
“আমার পকেটে আছে।”
“আচ্ছা, তবে বের করো।”
“তুমি বলতে পারলে না।”
“আমার বুদ্ধি নেই, যা চোখে দেখি তাও বুঝতে পারি নে, যা না দেখি তা আরো ভুল বুঝি।”
তখন হাবলু খুব আস্তে আস্তে পকেট থেকে ব্রাউন কাগজের একটা পুঁটুলি বের করে কুমুর কোলের উপর রেখে দৌড়ে পালাবার উপক্রম করলে।
“না, তোমাকে পালাতে দেব না।”
পুঁটুলিটা হাত দিয়ে চাপা দিয়ে ব্যস্ত হয়ে হাবলু বললে, “তা হলে এখন দেখো না।”
“না ভয় নেই, তুমি চলে গেলে তখন খুলব।”
“আচ্ছা জ্যাঠাইমা, তুমি জটাইবুড়িকে দেখেছ?”
“কী জানি, হয়তো দেখে থাকব, কিন্তু চিনতে সময় লাগে।”
“একতলায় উঠোনের পাশে কয়লার ঘরে সন্ধের সময় চামচিকের পিঠে চড়ে সে আসে।”
“চামচিকের পিঠে চড়ে সে আসে!”
“ইচ্ছে করলেই সে খুব ছোট্টো হতে পারে, চোখে প্রায় দেখাই যায় না।”
“সেই মন্তরটা তার কাছে শিখে নিতে হবে তো।”
“কেন, জ্যাঠাইমা?”
“আমি যদি পালাবার জন্যে কয়লার ঘরে ঢুকি তবুও যে আমাকে দেখতে পাওয়া যায়।”
হাবলু এ কথাটার কোনো মানে বুঝতে পারলে না। বললে, “কয়লার মধ্যে সিঁদুরের কৌটো লুকিয়ে রেখেছে। সেই সিঁদুর কোথা থেকে এনেছে জান?”
“বোধ হয় জানি।”
“আচ্ছা, বলো দেখি।”
“ভোরবেলাকার মেঘের ভিতর থেকে।”
হাবলু থমকে গেল। তাকে ভাবিয়ে দিলে। বিশেষ-সংবাদদাতা তাকে সাগরপারের দৈত্যপুরীর কথা বলেছিল। কিন্তু জ্যাঠাইমার কথাটা মনে হল বিশ্বাসযোগ্য, তাই কোনো বিরুদ্ধ তর্ক না তুলে বললে, “যে মেয়ে সেই কৌটো খুঁজে বের করে সিঁদুরটিপ কপালে পরবে সে হবে রাজরানী।”
“সর্বনাশ! কোনো হতভাগিনী খবর পেয়েছে নাকি?”
“সেজোপিসিমার মেয়ে খুদি জানে। ঝুড়ি নিয়ে ছন্নু যখন সকালে কয়লা বের করতে যায়, রোজ খুদি সেইসঙ্গে যায়– ও একটুও ভয় করে না।”
“ও যে ছেলেমানুষ, তাই রাজরানী হতেও ভয় নেই।”
বাইরে ঠাণ্ডা উত্তরে হাওয়া দিচ্ছিল তাই মোতিকে নিয়ে কুমু ঘরে গেল; সেখানে সোফায় বসে ওকে কোলে তুলে নিলে। পাশের তেপাইয়ে ছোটো রুপোর থালিতে ছিল শীতকালের ফুল– গাঁদা, কুন্দ, দোপাটি, জবা। প্রতিদিনের জোগানমত এই ফুলই মালীর তোলা। কুমু ছাদের কোণে বসে সূর্যোদয়ের দিকে মুখ করে দেবতাকে উৎসর্গ করে দেবে বলে এরা অপেক্ষা করে আছে। আজ তার সেই অনিবেদিত ফুল থালাসুদ্ধ নিয়ে সে হাবলুর কাছে ধরল; বললে, “নেবে ফুল?”
“হাঁ, নেব।”
“কী করবে বলো তো?”
“পুজো-পুজো খেলব।”
কুমুর কোমরে একটা সিল্কের রুমাল গোঁজা ছিল, সেইটেতে ফুলগুলি বেঁধে দিয়ে ওকে চুমো খেয়ে বললে, “এই নাও।” মনে মনে ভাবলে, “আমারও পুজো-পুজো খেলা হল।” বললে, “গোপাল, এর মধ্যে কোন্ ফুল তোমার সব চেয়ে ভালো লাগে, বলো তো?”
হাবলু বললে, “জবা।”
“কেন জবা ভালো লাগে বলব?”
“বলো দেখি।”
“ও যে ভোর না হতেই জটাইবুড়ির সিঁদুরের কৌটো থেকে রঙ চুরি করেছে।”
হাবলু খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে ভাবলে। হঠাৎ বলে উঠল, “জ্যাঠাইমা, জবা ফুলের রঙ ঠিক তোমার শাড়ির এই লাল পাড়ের মতো।” এইটুকুতে ওর মনের সব কথা বলা হয়ে গেল।
এমন সময় হঠাৎ পিছনে দেখে মধুসূদন। পায়ের শব্দ পাওয়া যায় নি। এখন অন্তঃপুরে আসবার সময় নয়। এই সময়টাতে বাইরের আপিসঘরে ব্যাবসাঘটিত কর্মের যত উচ্ছিষ্ট পরিশিষ্ট এসে জোটে; এই সময় দালাল আসে, উমেদার আসে, যত রকম খুচরো খবর ও কাগজপত্র নিয়ে সেক্রেটারি আসে। আসল কাজের চেয়ে এই-সব উপরি-কাজের ভিড় কম নয়।
৩৯
যে ভিক্ষুকের ঝুলিতে কেবল তুষ জমেছে চাল জোটে নি, তারই মতো মন নিয়ে আজ সকালে মধুসূদন খুব রুক্ষভাবেই বাইরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু অতৃপ্তির আকর্ষণ বড়ো প্রচণ্ড। বাধাতেই বাধার উপর টেনে আনে।
ওকে দেখেই হাবলুর মুখ শুকিয়ে গেল, বুক উঠল কেঁপে, পালাবার উপক্রম করলে। কুমু জোর করে চেপে ধরলে, উঠতে দিলে না।