যোগাযোগ

“দাদার চিঠি কি এসেছে?”

“চিঠির বাক্স তো এখনো খুলি নি, যদি থাকে তোমাকে পাঠিয়ে দেব।”

কুমু মধুসূদনের কথা অবিশ্বাস করতে আরম্ভ করে নি, সুতরাং এ কথাটাও মেনে নিলে।

“দাদার চিঠি এসেছে কি না একবার খোঁজ করবে কি?”

“যদি এসে থাকে, খাওয়ার পরে দুপুরবেলা নিজেই নিয়ে আসব।”

কুমু অধৈর্য দমন করে নীরবে সম্মত হল। তখন আর-একবার মধুসূদন কুমুর হাতখানা টেনে নেবার উপক্রম করছে এমন সময় শ্যামা হঠাৎ ঘরের মধ্যে ঢুকেই বলে উঠল, “ওমা, ঠাকুরপো যে!” বলেই বেরিয়ে যেতে উদ্যত।

মধুসূদন বললে, “কেন, কী চাই তোমার?”

“বউকে ভাঁড়ারে ডাকতে এসেছি। রাজরানী হলেও ঘরের লক্ষ্মী তো বটে; তা আজ না-হয় থাক্‌।” মধুসূদন সোফা থেকে উঠে কোনো কথা না বলে দ্রুত বাইরে চলে গেল।

আহারের পর যথারীতি শোবার ঘরের খাটে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে পান চিবোতে চিবোতে মধুসূদন কুমুকে ডেকে পাঠালে। তাড়াতাড়ি কুমু চলে এল। সে জানে আজ দাদার চিঠি পাবে। শোবার ঘরে ঢুকে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে রইল।

মধুসূদন গুড়গুড়ির নলটা রেখে পাশে দেখিয়ে দিয়ে বললে, “বোসো।”

কুমু বসল। মধুসূদন তাকে যে চিঠি দিলে তাতে কেবল এই কয়টি কথা আছে–

প্রাণপ্রতিমাসু

শুভাশীর্বাদরাশয়ঃ সন্তু

চিকিৎসার জন্য শীঘ্রই কলিকাতায় যাইতেছি। সুস্থ হইলে তোমাকে দেখিতে যাইব। গৃহকর্মের অবকাশমত মাঝে মাঝে কুশলসংবাদ দিলে নিরুদ্‌বিগ্ন হই।

এই ছোটো চিঠিটুকু মাত্র পেয়ে কুমুর মনে প্রথমে একটা ধাক্কা লাগল। মনে মনে বললে, “পর হয়ে গেছি।” অভিমানটা প্রবল হতে না হতেই মনে এল, “দাদার হয়তো শরীর ভালো নেই, আমার কী ছোটো মন! নিজের কথাটাই সব-আগে মনে পড়ে।”

মধুসূদন বুঝতে পারলে কুমু উঠি-উঠি করছে; বললে, “যাচ্ছ কোথায়, একটু বোসো।”

কুমুকে তো বসতে বললে, কিন্তু কী কথা বলবে মাথায় আসে না। অবিলম্বে কিছু বলতেই হবে, তাই সকাল থেকে যে কথাটা নিয়ে ওর মনে খটকা রয়েছে সেইটেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। বললে, “সেই এলাচদানার ব্যাপারটা নিয়ে এত হাঙ্গামা করলে কেন? ওতে লজ্জার কথা কী ছিল?”

“ও আমার গোপন কথা।”

“গোপন কথা! আমার কাছেও বলা চলে না?”

“না।”

মধুসূদনের গলা কড়া হয়ে এল, বললে, “এ তোমাদের নুরনগরি চাল, দাদার ইস্কুলে শেখা।”

কুমু কোনো জবাব করলে না। মধুসূদন তাকিয়া ছেড়ে উঠে বসল, “ঐ চাল তোমার না যদি ছাড়াতে পারি তা হলে আমার নাম মধুসূদন না।”

“কী তোমার হুকুম, বলো।”

“সেই মোড়ক কে তোমাকে দিয়েছিল বলো।”

“হাবলু।”

“হাবলু! তা নিয়ে এত ঢাকাঢাকি কেন?”

“ঠিক বলতে পারি নে।”

“আর কেউ তার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে?”

“না।”

“তবে?”

“ঐ পর্যন্তই; আর কোনো কথা নেই।”

“তবে এত লুকোচুরি কেন?”

“তুমি বুঝতে পারবে না।”

কুমুর হাত চেপে ধরে ঝাঁকানি দিয়ে মধু বললে, “অসহ্য তোমার বাড়াবাড়ি।”

কুমুর মুখ লাল হয়ে উঠল, শান্ত স্বরে বললে, “কী চাও তুমি, বুঝিয়ে বলো। তোমাদের চাল আমার অভ্যেস নেই সে কথা মানি।”

মধুসূদনের কপালের শিরদুটো ফুলে উঠল। কোনো জবাব ভেবে না পেয়ে ইচ্ছে হল ওকে মারে। এমন সময় বাইরে থেকে গলা-খাঁকারি শোনা গেল, সেইসঙ্গে আওয়াজ এল, “আপিসের সায়েব এসে বসে আছে।” মনে পড়ল আজ ডাইরেক্টরদের মীটিং। লজ্জিত হল যে সে এজন্যে প্রস্তুত হয় নি– সকালটা প্রায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ গেছে। এতবড়ো শৈথিল্য এতই ওর স্বভাব ও অভ্যাস-বিরুদ্ধ যে, এটা সম্ভব হল দেখে ও নিজে স্তম্ভিত।

৪০

মধুসূদন চলে যেতেই কুমু খাট থেকে নেমে মেজের উপর বসে পড়ল। চিরজীবন ধরে এমন সমুদ্রে কি তাকে সাঁতার কাটতে হবে যার কূল কোথাও নেই? মধুসূদন ঠিকই বলেছে ওদের সঙ্গে তার চাল তফাত। আর সকল রকম তফাতের চেয়ে এইটেই দুঃসহ। কী উপায় আছে এর?

এক সময়ে হঠাৎ কী মনে পড়ল, কুমু চলল নীচের তলায় মোতির মার ঘরের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় দেখে শ্যামাসুন্দরী উপরে উঠে আসছে।

“কী বউ, চলেছ কোথায়? আমি যাচ্ছিলুম তোমার ঘরেই।”

“কোনো কথা আছে?”

“এমন কিছু নয়। দেখলুম ঠাকুরপোর মেজাজ কিছু চড়া, ভাবলুম তোমাকে একবার জিজ্ঞাসা করে জানি, নতুন প্রণয়ে খটকা বাধল কোন্‌খানটাতে। মনে রেখো বউ, ওর সঙ্গে কী রকম করে বনিয়ে চলতে হয় সে পরামর্শ আমরাই দিতে পারি। বকুলফুলের ঘরে চলেছ বুঝি? তা যাও, মনটা খোলসা করে এসো গে।”

আজ হঠাৎ কুমুর মনে হল শ্যামাসুন্দরী আর মধুসূদন একই মাটিতে গড়া এক কুমোরের চাকে। কেন এ কথা মাথায় এল বলা শক্ত। চরিত্র বিশ্লেষণ করে কিছু বুঝেছে তা নয়, আকারে-প্রকারে বিশেষ যে মিল তাও নয়, তবু দুজনের ভাবগতিকের একটা অনুপ্রাস আছে, যেন শ্যামাসুন্দরীর জগতে আর মধুসূদনের জগতে একই হাওয়া। শ্যামাসুন্দরী যখন বন্ধুত্ব করতে আসে তাও কুমুকে উলটো দিকে ঠেলা দেয়, গা কেমন করে ওঠে।

মোতির মার শোবার ঘরে ঢুকেই কুমু দেখলে নবীনে তাতে মিলে কী একটা নিয়ে হাত-কাড়াকাড়ি চলছে। ফিরে যাবে যাবে মনে করছে, এমন সময় নবীন বলে উঠল, “বউদিদি, যেয়ো না, যেয়ো না। তোমার কাছেই যাচ্ছিলুম, নালিশ আছে।”

“কিসের নালিশ?”

“একটু বোসো, দুঃখের কথা বলি।”

তক্তপোশের উপর কুমু বসল।

নবীন বললে, “বড়ো অত্যাচার! এই ভদ্রমহিলা আমার বই রেখেছেন লুকিয়ে।”

“এমন শাসন কেন?”

“ঈর্ষা– যেহেতু নিজে ইংরেজি পড়তে পারেন না। আমি স্ত্রীশিক্ষার পক্ষে, কিন্তু উনি স্বামী-জাতির এডুকেশনের বিরোধী। আমার বুদ্ধির যতই উন্নতি হচ্ছে, ওঁর বুদ্ধির সঙ্গে ততই গরমিল হওয়াতে ওঁর আক্রোশ। অনেক করে বোঝালেম যে, এতবড়ো যে সীতা তিনিও রামচন্দ্রের পিছনে পিছনেই চলতেন; বিদ্যেবুদ্ধিতে আমি যে তোমার চেয়ে অনেক দূরে এগিয়ে এগিয়ে চলছি এতে বাধা দিয়ো না।”

0 Shares