যোগাযোগ

“দেবতার ‘পরে বিশ্বাস থাকলে গ্রহকে বিশ্বাস করতুম না দাদা। ডাক্তারকে যে মানে না হাতুড়েকে মানতে তার বাধে না।”

নিজের গ্রহকে যাচাই করে নেবার জন্যে মধুসূদনের যে পরিমাণ আগ্রহ হল, সেই পরিমাণ ঝাঁজের সঙ্গে বললে, “লেখাপড়া শিখে বাঁদর, তোমার এই বিদ্যে? যে যা বলে তাই বিশ্বাস কর?”

“লোকটার কাছে যে ভৃগুসংহিতা রয়েছে– যেখানে যে-কেউ যে-কোনো কালে জন্মেছে, জন্মাবে, সকলের কুষ্ঠি একেবারে তৈরি, সংস্কৃত ভাষায় লেখা, এর উপর তো আর কথা চলে না। হাতে হাতে পরীক্ষা করে দেখে নাও।”

“বোকা ভুলিয়ে যারা খায়, বিধাতা তাদের পেট ভরাবার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে তোমাদের মতো বোকাও সৃষ্টি করে রাখেন।”

“আবার সেই বোকাদের বাঁচাবার জন্যে তোমাদের মতো বুদ্ধিমানও সৃষ্টি করেন। যে মারে তার উপরে তাঁর যেমন দয়া, যাকে মারে তার উপরেও তেমনি। ভৃগুসংহিতার উপরে তোমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি চালিয়ে দেখোই-না।”

“আচ্ছা, বেশ, কাল সকালেই আমাকে নিয়ে যেয়ো, দেখব তোমার কুম্ভকোনামের চালাকি।”

“তোমার যেরকম জোর অবিশ্বাস দাদা, ওতে গণনায় গোল হয়ে যেতে পারে। সংসারে দেখা যায় মানুষকে বিশ্বাস করলে মানুষ বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। গ্রহদেরও ঠিক সেই দশা, দেখো-না কেন সাহেবগুলো গ্রহ মানে না বলে গ্রহের ফল ওদের উপর খাটে না। সেদিন তেরোস্পর্শে বেরিয়ে তোমাদের ছোটোসাহেব ঘোড়দৌড়ে বাজি জিতে এল– আমি হলে বাজি জেতা দুরস্তাং ঘোড়াটা ছিটকে এসে আমার পেটে লাথি মেরে যেত। দাদা, এই-সব গ্রহনক্ষত্রের হিসেবের উপর তোমাদের বুদ্ধি খাটাতে যেয়ো না, একটু বিশ্বাস মনে রেখো।”

মধুসূদন খুশি হয়ে স্মিতহাস্যে গুড়গুড়িতে মনোযোগ দিলে।

পরদিন সকাল সাতটার মধ্যে মধুসূদন নবীনের সঙ্গে এক সরু গলির আবর্জনার ভিতর দিয়ে বেঙ্কট শাস্ত্রীর বাসায় গিয়ে উপস্থিত। অন্ধকার একতলার ভাপ্‌সা ঘর; লোনাধরা দেয়াল ক্ষতবিক্ষত, যেন সাংঘাতিক চর্মরোগে আক্রান্ত, তক্তপোশের উপর ছিন্ন মলিন একখানা শতরঞ্চ, এক প্রান্তে কতকগুলো পুঁথি এলোমেলো জড়ো করা, দেয়ালের গায়ে শিবপার্বতীর এক পট। নবীন হাঁক দিলে, “শাস্ত্রীজি।” ময়লা ছিটের বালাপোশ গায়ে, সামনের মাথা কামানো, ঝুঁটিওয়ালা, কালো বেঁটে রোগা এক ব্যক্তি ঘরে এসে ঢুকল; নবীন তাকে ঘটা করে প্রণাম করলে। চেহারা দেখে মধুসূদনের একটুও ভক্তি হয় নি– কিন্তু দৈবের সঙ্গে দৈবজ্ঞের কোনোরকম ঘনিষ্ঠতা আছে জেনে ভয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি একটা আধাআধি রকম অভিবাদন সেরে নিলে। নবীন মধুসূদনের একটি ঠিকুজি জ্যোতিষীর সামনে ধরতেই সেটা অগ্রাহ্য করে শাস্ত্রী মধুসূদনের হাত দেখতে চাইলে। কাঠের বাক্স থেকে কাগজ-কলম বের করে নিয়ে নিজে একটা চক্র তৈরি করে নিলে। মধুসূদনের মুখের দিকে চেয়ে বললে, “পঞ্চম বর্গ।” মধুসূদন কিছুই বুঝলে না। জ্যোতিষী আঙুলের পর্ব গুনতে গুনতে আউড়ে গেল, কবর্গ, চবর্গ, টবর্গ, তবর্গ, পবর্গ। এতেও মধুসূদনের বুদ্ধি খোলসা হল না। জ্যোতিষী বললে, “পঞ্চম বর্ণ।” মধুসূদন ধৈর্য ধরে চুপ করে রইল। জ্যোতিষী আওড়াল, প, ফ, ব, ভ, ম। মধুসূদন এর থেকে এইটুকু বুঝলে যে, ভৃগুমুনি ব্যাকরণের প্রথম অধ্যায় থেকেই তার সংহিতা শুরু করেছেন। এমন সময় বেঙ্কট শাস্ত্রী বলে উঠল, “পঞ্চাক্ষরকং।”

নবীন চকিত হয়ে মধুসূদনের কাছে চুপি চুপি বললে, “বুঝেছি দাদা।”

“কী বুঝলে?”

“পঞ্চম বর্গের পঞ্চম বর্ণ ম, তার পরে পঞ্চ অক্ষর ম-ধু-সূ-দ-ন। জন্ম-গ্রহের অদ্ভুত কৃপায় তিনটে পাঁচ এক জায়গায় মিলেছে।”

মধুসূদন স্তম্ভিত। বাপ মায়ে নাম রাখবার কত হাজার বছর আগেই নামকরণ ভৃগুমুনির খাতায়! নক্ষত্রদের এ কী কাণ্ড! তার পরে হতবুদ্ধি হয়ে শুনে গেল ওর জীবনের সংক্ষিপ্ত অতীত ইতিহাস সংস্কৃত ভাষায় রচিত। ভাষা যত কম বুঝলে, ভক্তি ততই বেড়ে উঠল। জীবনটা আগাগোড়া ঋষিবাক্য মূর্তিমান। নিজের বুকের উপর হাত বুলিয়ে দেখলে, দেহটা অনুস্বার-বিসর্গ-তদ্ধিত-প্রত্যয়ের মসলা দিয়ে তৈরি কোন্‌ তপোবনে লেখা একটা পুঁথির মতো। তার পর দৈবজ্ঞের শেষ কথাটা এই যে, মধুসূদনের ঘরে একটা লক্ষ্মীর অবির্ভাব হবে বলে পূর্ব হতেই ঘরে অভাবনীয় সৌভাগ্যের সূচনা। অল্পদিন হল তিনি এসেছেন নববধূকে আশ্রয় করে। এখন থেকে সাবধান। কেননা ইনি যদি মনঃপীড়া পান, ভাগ্য কুপিত হবে।

বেঙ্কট শাস্ত্রী বললে, কোপের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। জাতক যদি এখনো সতর্ক না হয় বিপদ বেড়ে চলবে। মধুসূদন স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল। মনে পড়ে গেল বিবাহের দিনই প্রকাণ্ড সেই মুনফার খবর; আর তার কয়দিনের মধ্যেই এই পরাভব। লক্ষ্মী স্বয়ং আসেন সেটা সৌভাগ্য, কিন্তু তার দায়িত্বটা কম ভয়ংকর নয়।

ফেরবার সময় মধুসূদন গাড়িতে স্তব্ধ হয়েই বসে রইল। এক সময় নবীন বলে উঠল, “ঐ বেঙ্কট শাস্ত্রীর কথা একটুও বিশ্বাস করি নে; নিশ্চয় ও কারো কাছ থেকে তোমার সমস্ত খবর পেয়েছে।”

“ভারি বুদ্ধি তোমার! যেখানে যত মানুষ আছে আগেভাগে তার খবর নিয়ে রেখে দিচ্ছে; সোজা কথা কিনা!”

“মানুষ জন্মাবার আগেই তার কোটি কোটি কুষ্ঠি লেখার চেয়ে এটা অনেক সোজা! ভৃগুমুনি এত কাগজ পাবেন কোথায়, আর বেঙ্কট স্বামীর ঐ ঘরে এত জায়গা হবে কেমন করে?”

“এক আঁচড়ে হাজারটা কথা লিখতে জানতেন তাঁরা।”

0 Shares