যোগাযোগ

“অসম্ভব।”

“যা তোমার বুদ্ধিতে কুলোয় না তাই অসম্ভব। ভারি তোমার সায়ান্স! এখন তর্ক রেখে দাও, সেদিন ওদের বাড়ি থেকে যে সরকার এসেছিল, তাকে তুমি নিজে গিয়ে ডেকে এনো। আজই, দেরি কোরো না।”

দাদাকে ঠকিয়ে নবীনের মনের ভিতরটাতে অত্যন্ত অস্বস্তিবোধ হতে লাগল। ফন্দিটা এত সহজ, এর সফলতাটা দাদার পক্ষে এত হাস্যকর যে, তারই অমর্যাদায় ওকে লজ্জা ও কষ্ট দিলে। দাদাকে উপস্থিতমত ছোটো অনেক ফাঁকি অনেকবার দিতে হয়েছে, কিছু মনে হয় নি; কিন্তু এত করে সাজিয়ে এতবড়ো ফাঁকি গড়ে তোলার গ্লানি ওর চিত্তকে অশুচি করে রেখে দিলে।

৪২

মধুসূদনের মন থেকে মস্ত একটা ভার গেল নেমে, আত্মগৌরবের ভার– যে কঠোর গৌরব-বোধ ওর বিকাশোন্মুখ অনুরক্তিকে কেবলই পাথর-চাপা দিয়েছে। কুমুর প্রতি ওর মন যখন মুগ্ধ তখনো সেই বিহ্বলতার বিরুদ্ধে ভিতরে ভিতরে চলেছিল লড়াই। যতই অনন্যগতি হয়ে কুমুর কাছে ধরা দিয়েছে, ততই নিজের অগোচরে কুমুর ‘পরে ওর ক্রোধ জমেছে। এমন সময় স্বয়ং নক্ষত্রদের কাছ থেকে যখন আদেশ এল যে, লক্ষ্মী এসেছেন ঘরে, তাঁকে খুশি করতে হবে, সকল দ্বন্দ্ব ঘুচে গিয়ে ওর দেহমন যেন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল; বার বার আপন মনে আবৃত্তি করতে লাগল– লক্ষ্মী, আমারই ঘরে লক্ষ্মী, আমার ভাগ্যের পরম দান। ইচ্ছে করতে লাগল– এখনই সমস্ত সংকোচ ভাসিয়ে দিয়ে কুমুর কাছে স্তুতি জানিয়ে আসে, বলে আসে, “যদি কোনো ভুল করে থাকি, অপরাধ নিয়ো না।” কিন্তু আজ আর সময় নেই, ব্যবসায়ের ভাঙন সারবার কাজে এখনই আপিসে ছুটতে হবে, বাড়িতে খেয়ে যাবার অবকাশ পর্যন্ত জুটল না।

এ দিকে সমস্তদিন কুমুর মনের মধ্যে তোলপাড় চলেছে। সে জানে কাল দাদা আসবেন, শরীর তাঁর অসুস্থ। তাঁর সঙ্গে দেখাটা সহজ হবে কি না নিশ্চিত জানবার জন্যে মন উদ্‌বিগ্ন হয়ে আছে। নবীন কোথায় কাজে গেছে, এখনো এল না। সে নিঃসন্দেহ জানত আজ স্বয়ং মধুসূদন এসে বউরানীকে সকল রকমে প্রসন্ন করবে; আগেভাগে কোনো আভাস দিয়ে রসভঙ্গ করতে চায় না।

আজ ছাতে বসবার সুবিধা ছিল না। কাল সন্ধ্যা থেকে মেঘ করে আছে, আজ দুপুর থেকে টিপ্‌ টিপ্‌ করে বৃষ্টি শুরু হল। শীতকালের বাদলা, অনিচ্ছিত অতিথির মতো। মেঘে রঙ নেই, বৃষ্টিতে ধ্বনি নেই, ভিজে বাতাসটা যেন মনমরা, সূর্যালোকহীন আকাশের দৈন্যে পৃথিবী সংকুচিত। সিঁড়ি থেকে উঠেই শোবার ঘরে ঢোকবার পথে যে ঢাকা ছাদ আছে সেইখানে কুমু মাটিতে বসে। থেকে থেকে গায়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে। আজ এই ছায়াম্লান আর্দ্র একঘেয়ে দিনে কুমুর মনে হল, তার নিজের জীবনটা তাকে যেন অজগরের মতো গিলে ফেলেছে, তারই ক্লেদাক্ত জঠরের রুদ্ধতার মধ্যে কোথাও একটুমাত্র ফাঁক নেই। যে দেবতা ওকে ভুলিয়ে আজ এই নিরুপায় নৈরাশ্যের মধ্যে এনে ফেললে তার উপরে যে অভিমান ওর মনে ধোঁয়াচ্ছিল আজ সেটা ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠল। হঠাৎ দ্রুত উঠে পড়ল। ডেস্ক খুলে বের করলে সেই যুগলরূপের পট। রঙিন রেশমের ছিট দিয়ে সেটা মোড়া।

সেই পট আজ ও নষ্ট করে ফেলতে চায়। যেন চীৎকার করে বলতে চায়, তোমাকে আমি একটুও বিশ্বাস করি নে। হাত কাঁপছে, তাই গ্রন্থি খুলতে পারছে না; টানাটানিতে সেটা আরো আঁট হয়ে উঠল, অধীর হয়ে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেললে। অমনি চিরপরিচিত সেই মূর্তি অনাবৃত হতেই আর সে থাকতে পারলে না; তাকে বুকে চেপে ধরে কেঁদে উঠল। কাঠের ফ্রেম বুকে যত বাজে ততই আরো বেশি চেপে ধরে।

এমন সময়ে শোবার ঘরে এল মুরলী বেহারা বিছানা করতে। শীতে কাঁপছে তার হাত। গায়ে একখানা জীর্ণ ময়লা র৻াপার। মাথায় টাক, রগ টেপা, গাল বসা, কিছুকালের না-কামানো কাঁচাপাকা দাড়ি খোঁচা খোঁচা হয়ে উঠেছে। অনতিকাল পূর্বেই সে ম্যালেরিয়ায় ভুগেছিল, শরীরে রক্ত নেই বললেই হয়, ডাক্তার বলেছিল কাজ ছেড়ে দিয়ে দেশে যেতে, কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি।

কুমু বললে, “শীত করছে মুরলী?”

“হাঁ মা, বাদল করে ঠাণ্ডা পড়েছে।”

“গরম কাপড় নেই তোমার?”

“খেতাব পাবার দিনে মহারাজা দিয়েছিলেন, নাতির খাঁসির বেমারি হতেই ডাক্তারের কথায় তাকে দিয়েছি মা।”

কুমু একটি পুরোনো ছাই রঙের আলোয়ান পাশের ঘরের আলমারি থেকে বের করে এনে বললে, “আমার এই কাপড়টি তোমাকে দিলুম।”

মুরলী গড় হয়ে বললে, “মাপ করো মা, মহারাজা রাগ করবেন।”

কুমুর মনে পড়ে গেল, এ বাড়িতে দয়া করবার পথ সংকীর্ণ। কিন্তু ঠাকুরের কাছ থেকে নিজের জন্যেও যে ওর দয়া চাই, পুণ্যকর্ম তারই পথ। কুমু ক্ষোভের সঙ্গে আলোয়ানটা মাটিতে ফেলে দিলে।

মুরলী হাত জোড় করে বললে, “রানীমা, তুমি মা লক্ষ্মী, রাগ কোরো না। গরম কাপড়ে আমার দরকার হয় না। আমি থাকি হুঁকাবরদারের ঘরে, সেখানে গামলায় গুলের আগুন, আমি বেশ গরম থাকি।”

কুমু বললে, “মুরলী, নবীন ঠাকুরপো যদি বাড়ি এসে থাকেন তাঁকে ডেকে দাও।”

নবীন ঘরে ঢুকতেই কুমু বললে, “ঠাকুরপো, তোমাকে একটি কাজ করতেই হবে। বলো, করবে?”

“নিজের অনিষ্ট যদি হয় এখনই করব, কিন্তু তোমার অনিষ্ট হলে কিছুতেই করব না।”

“আমার আর কত অনিষ্ট হবে? আমি ভয় করি নে।” বলে নিজের হাত থেকে মোটা সোনার বালাজোড়া খুলে বললে, “আমায় এই বালা বেচে দাদার জন্যে স্বস্ত্যয়ন করাতে হবে।”

“কিছু দরকার হবে না, বউরানী, তুমি তাঁকে যে ভক্তি করো তারই পুণ্যে প্রতি মুহূর্তে তাঁর জন্যে স্বস্ত্যয়ন হচ্ছে।”

0 Shares